অঙ্গীকার ডেস্ক: বগুড়ার শাজাহানপুরে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত কবিরাজ মোজাফফর হোসেন ওরফে বাবা হুজুরের (৬০) আস্তানায় পাঁচ শতাধিক কাঁচের বয়ামে জিন বন্দি করে রাখার খবর পাওয়া গেছে।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার মাধ্যমে জিনদের বন্দি করতেন। এসব জিনের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের নামে ভক্তদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের নিশিন্দারা মধ্যপাড়ায় তার প্রতিষ্ঠিত আল জামিয়া আল আরাবিয়া দারুল হেদায়া কওমি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের ২৩ দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি।
বগুড়া ডিবি পুলিশের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর আবদুর রাজ্জাক হুজুরের আস্তানায় জিন বন্দি রাখা হয়েছে এমন বয়াম থাকার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, পুলিশের সব ইউনিট কাজ করছে। এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে; তদন্তের স্বার্থে এখন তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আশা করা হচ্ছে শিগগিরই ভালো কোনো খবর দেওয়া সম্ভব হবে।
পুলিশ ও স্বজনরা জানান, কবিরাজ মোজাফফর হোসেন ওরফে বাবা হুজুর নাটোরের সিংড়া উপজেলার সুকাশ ইউনিয়নের সুকাশ নওদাপাড়া গ্রামের মৃত সায়েদ মণ্ডলের ছেলে ছেলে। তার দুজন স্ত্রী ও দুটি মেয়ে রয়েছে। তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে বগুড়া শহরের নিশিন্দারা এলাকায় বসবাস করতেন। তিনি আল জামিয়া আল আরাবিয়া দারুল হেদায়া কওমি হাফেজিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।
গত ৪ মে সকালে তিনি কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বগুড়ার দিকে আসছিলেন। সাড়ে ৯টার দিকে অটোরিকশা বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়নের জোড়া কৃষি কলেজ এলাকায় বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে পৌঁছে। এ সময় দুটি মোটরবাইকে আসা দুর্বৃত্তরা অস্ত্রের মুখে অটোরিকশার পথরোধ করে।
দুজন বাইক থেমে নেমে প্রকাশ্যে মোজাফফর হোসেনের বুকে কয়েকটি গুলি করে বীরদর্পে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ঘাতকদের মুখে মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস ও মাথায় টুপি ছিল। প্রকাশ্যে গুলিতে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
এ ব্যাপারে শাজাহানপুর থানায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ২৩ দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ হত্যারহস্য উদঘাটন ও এর সঙ্গে কারা জড়িত তা বের করতে পারেনি।
সরেজমিন বগুড়া শহরের নিশিন্দারা মধ্যপাড়া এলাকায় গিয়ে জনগণের সঙ্গে ও বাবা হুজুরের সহকারী মাওলানা মাহবুব হোসেনের সঙ্গে কথা বলে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি হাফেজ ও মাদ্রাসা পরিচালক হলেও নামাজ আদায় ও রোজা রাখতেন না।
আধ্যাত্মিক ক্ষমতার মাধ্যমে জিন হাজির করে সমস্যার সমাধান ও দুষ্ট জিনকে কাঁচের বয়ামে বন্দি করতেন। প্রেম, বিয়ে বিচ্ছেদ, ব্যবসায় মন্দা, সন্তান না হওয়া, আইপিএল খেলার ভবিষ্যৎবাণী করাসহ বিভিন্ন কবিরাজি চিকিৎসা দিতেন।
বাবা হুজুরের আস্তানায় দেখা গেছে, তিনটি বস্তায় ভরা ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক কাঁচের বয়াম রয়েছে। প্রতিটি বয়াম গামছা দিয়ে মুড়িয়ে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশে রয়েছে বিভিন্ন বই ও তাবিজ লেখার কাগজ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম।
হুজুরের সহকারী মাওলানা মাহবুব হোসেন জানান, প্রতিটি বয়ামে বাধ্য ও অবাধ্য জিনকে বন্দি করে রাখা আছে। এসব জিন দিয়ে তিনি (বাবা হুজুর) ভক্তদের সেবা দিতেন। করোনার কারণে মাদ্রাসা বন্ধ থাকলেও তিনি আস্তানায় বসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী-পুরুষকে চিকিৎসা ও সমস্যার সমাধান দিতেন। অনেকে ফোনেও চিকিৎসা ও সমস্যার সমাধান নিতেন।
তবে মাদ্রাসার আশপাশের বাসিন্দারা হুজুর সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি নন। এমনকি মাদ্রাসা ভবনের মালিক তাহমিদ বিরক্ত হয়ে কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
মাদ্রাসা সংলগ্ন রূপসী লেডিস টেইলার্সের মালিক রেজাউল করিম কিরণ জানান, বাবা হুজুর কখনও তাদের সঙ্গে কথা বলতেন না। মাদ্রাসার ভিতরে কবিরাজি চিকিৎসা করতেন।
এদিকে বাবা হুজুর হত্যাকাণ্ডের ২৩ দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারসহ নানাভাবে তদন্ত করলেও কোনো ক্লু উদঘাটন করতে পারেননি। পুলিশ এ খুনের সঙ্গে জঙ্গি, সর্বহারা, আইপিএল জুয়া, জিন হাজির করে চিকিৎসা দেওয়া, তাবিজ বিক্রি করা, দুই স্ত্রী, বড় পক্ষের মেয়ের দ্বিতীয় বিয়েসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাঠে থাকলেও তারা সঠিক কোনো তথ্য পায়নি।
হুজুরের সহকারী মাওলানা মাহবুব হোসেনকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেও হত্যার কারণ সম্পর্কে তথ্য মেলেনি।
বগুড়া ডিবি পুলিশের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর আবদুর রাজ্জাক জানান, হুজুরের আস্তানায় জিন বন্দি করে রাখা পাঁচ শতাধিক বয়াম পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কাজ করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেলেও তদন্তের স্বার্থে এখনই তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তিনি আশা করেন, শিগগিরই বাবা হুজুর হত্যারহস্য উন্মোচন ও ঘাতকদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হবেন।