‘তুই একটা নষ্টা মেয়ে, তোকে শাস্তি পেতে হবে’ এরকম ফতোয়া দিয়ে বেত্রাঘাত করার অপমান সহ্য করতে না পেরে ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহননের পথ বেছে নেন রোকেয়া খাতুন নামের এক গৃহবধূ।
এর আগে রোকেয়াকে (২৫) তওবা করান মওলানা আবুল খায়ের নামের স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম।গত ১০ জুন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বৈকারি ইউনিয়নের মৃগীডাঙা গ্রামে রোকেয়ার শ্বশুরবাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। পরের দিন গতকাল শুক্রবার ঘরের আড়ায় ওড়নায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন রোকেয়া।ফতোয়া দিয়ে বেত্রাঘাত করে আত্মহননের পথে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ এনে আজ শনিবার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন রোকেয়ার বাবা মফিজুল ইসলাম। মফিজুল ইসলাম এ ঘটনায় জড়িত এরশাদ, সাইফুল ইসলাম, এরশাদের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ও মাওলানা আবুল খায়েরের বিচার দাবি করেছেন।সংবাদ সম্মেলনে মফিজুল ইসলাম অভিযোগ করেন, সাত থেকে বছর আগে তাঁর মেয়ে রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয় মৃগীডাঙা গ্রামের আবু জাফরের ছেলে সাদ্দাম হোসেনের। তাদের ঘরে সামিয়া নামের ছয় বছরের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। সাদ্দামের বোনজামাই ইস্রাফিল বিভিন্ন সময় রোকেয়াকে কুপ্রস্তাব দিয়ে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। এরই মধ্যে গত ৬ জুন শ্বশুরবাড়ি থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান তাঁর মেয়ে রোকেয়া। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, ইস্রাফিল ও তাঁর বোনজামাই এরশাদের সহায়তায় রোকেয়াকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে গত ৯ জুন এরশাদ রোকেয়াকে নিয়ে ফের ফিরে আসেন এবং তাঁকে রোকেয়ার শ্বশুরবাড়িতে রেখে যান। এসব ঘটনা জেনেও রোকেয়ার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও পরিবারের লোকজন তাকে গ্রহণ করে এবং আবারও সাদ্দামের সংসার করার পক্ষে মত দেন। এর একদিন পর এরশাদ তাঁর শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ও এলাকার হাজি সাইফুল ইসলাম রোকেয়াদের বাড়িতে আসেন। সেখানে এসে তারা রোকেয়াকে ‘নষ্টা মেয়ে’ বলে অপবাদ দিয়ে তাকে ঘরে তুলতে হলে তওবা করতে হবে এবং ৫১টি বেত্রাঘাত খেতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে এই বাড়িতে থাকতে দেওয়া হবে না। তাদের হুমকি ও চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত রোকেয়ার স্বামী সাদ্দাম ও শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তাদের এই ফতোয়া মেনে নিতে বাধ্য হন বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন মফিজুল ইসলাম।
এদিকে, ফতোয়া অনুযায়ী এলাকার মৃগীডাঙা গ্রামের মসজিদের ইমাম মাওলানা আবুল খায়ের রোকেয়াকে তওবা করান। এ সময় রোকেয়ার বাবা সেখানে উপস্থিত থেকে বাড়ি চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর হাজি সাইফুল রোকেয়াকে বেত্রাঘাত করতে শুরু করেন। সাইফুলের হাত থেকে বেতটি কেড়ে নিয়ে এরশাদ নিজেই রোকেয়াকে এক এক করে ৫১টি বেত্রাঘাত করেন। বিকট শব্দে কান্নাকাটি এবং চিৎকার করে বেত্রাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন গৃহবধূ রোকেয়া। এ অবস্থায় সাইফুল, এরশাদ ও শহীদুল ফের তাঁকে ‘নষ্টা মেয়ে’ বলে গালিগালাজ করে ফিরে যান। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার সকালেই রোকেয়া নিজ ঘরের আড়ায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
সাতক্ষীরা সদর থানায় খবর দেওয়ার পর পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) স্বপন কুমার মণ্ডলের উপস্থিতিতে রোকেয়ার লাশের সুরতহাল রিপোর্ট হয়। ময়নাতদন্ত শেষে তাঁকে দাফন করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) স্বপন কুমার মণ্ডল জানান, ময়নাতদন্তের পরও তিনি রোকেয়াদের বাড়িতে গিয়ে ফতোয়ার বিষয়টি তদন্ত করেছেন। আত্মহননের পেছনে এই ফতোয়া এবং বেত্রাঘাতের সঙ্গে জড়িতরা রয়েছেন কিনা সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরদিকে, রোকেয়ার বাবা মফিজুল ইসলাম আত্মহননে প্ররোচণাকারীদের বিচার দাবি করেছেন।