সামনে আসছে বিএনপির “অসহোযোগ”আন্দোলন কর্মসূচি।
বিএনপি তাদের সমমনাদের নিয়ে সরকার পতনে এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলনে টানা কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে। আগামীকাল রোববার থেকে ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ শেষে এক দিন বিরতি দিয়ে বুধবার থেকে আবারও দু’দিনের অবরোধ দেবে। আর ১২ নভেম্বর থেকে তারা বিরতিহীন কিংবা অসহযোগ আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিজয় না আসা পর্যন্ত এক দফার আন্দোলন চলবে। নেতাকর্মী, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সমমনা প্রত্যেকে সরকারের উস্কানিতে পা না দিয়ে কর্মসূচি সফলে ভূমিকা পালন করবেন।’
বিএনপির নেতারা জানান, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ড ও পরে ধরপাকড়ের ধাক্কা দলে লেগেছে। এ জন্য আন্দোলনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রথমে এক দিন হরতাল, পরে দু’দফায় অবরোধ দেওয়া হয়েছে। নেতাকর্মীকে দম দিতেই এ সপ্তাহে সর্বাত্মক অবরোধ থাকলেও মাঝে বিরতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। এর মাধ্যমে বিএনপির হাইকমান্ড আন্দোলনের নামে যে জনগণের জীবন-জীবিকা জিম্মি হয়নি, সে বার্তা দেবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও নিজেদের উদারপন্থি ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। তবে পরের সপ্তাহ থেকে ধাপে ধাপে কঠোর আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপিসহ সমমনা দলের শীর্ষ নেতারা। এ কৌশলের অংশ হিসেবে আগামী মঙ্গলবার বিরতি দিয়ে পরের দু’দিন বুধ ও বৃহস্পতিবার সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর ১০ ও ১১ নভেম্বর বিরতি দিয়ে ১২ নভেম্বর থেকে টানা অবরোধ কিংবা অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা আসতে পারে।
বিএনপি ও সমমনা সূত্রের ভাষ্য, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে হামলা, সংঘর্ষ এবং পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য নেতাকর্মীরা প্রস্তুত ছিলেন না। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের জন্যই সেদিন সবচেয়ে বড় গণজমায়েত করেছিল। কিন্তু সংঘর্ষের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান, গণগ্রেপ্তার, মামলা, হয়রানিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। এমনকি নিজেদের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। গ্রেপ্তার এড়াতে বাসাবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থান খুঁজতে বেগ পেতে হয়। এখনও অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আছেন। তবে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতে সক্ষম হয়েছেন নেতাকর্মীরা। এবার সংগঠিতভাবে মাঠে নামার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির মধ্যম সারির একাধিক নেতা জানান, ২৮ অক্টোবরের বিপর্যয় থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনায় এবার নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নেতাকর্মীকে আবার এক প্ল্যাটফর্মে আনার প্রক্রিয়া শেষ করেছে হাইকমান্ড। সমষ্টিগত শক্তি নিয়েই তারা রাজপথে নামতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান জানান, তাদের আর পিছু হটার সুযোগ নেই। নিজের জন্যই নিজেকে লড়তে হবে। পুরো দেশটা কারাগার বানালেও দমে যাবেন না। শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনায় দলের শেষ কর্মীও এ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন– এমন প্রস্তুতি নিয়েছেন।
দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীর এমন মনোভাব এবং প্রস্তুতির মধ্যে পুরো আন্দোলনকে মনিটর করতে পৃথক সেল গঠন করা হয়েছে। যেসব সাংগঠনিক ইউনিট ন্যূনতম গাফিলতি করবে, নিষ্ক্রিয় থাকবে কিংবা অজুহাত দেখাবে, তাদের বিষয়ে খোঁজখবর শুরু হয়েছে। এমনকি যারা পদে বসে রাজপথে না নেমে ফেসবুকে ‘বিপ্লব’ করছেন, তাদের রাখা হচ্ছে আতশি কাচের নিচে। সবার আমলনামা সংগ্রহ করছে মনিটরিং সেল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির দপ্তর-সংশ্লিষ্ট এক নেতা জানান, বেশ কয়েকটি জেলা ও উপজেলার বিষয়ে হাইকমান্ড নড়েচড়ে বসেছে। বিশেষ করে ঢাকা ও আশপাশের জেলা নিয়ে সক্রিয় হয়েছে। হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে তাদের সতর্ক করা হয়েছে। নরসিংদী জেলার দুই শীর্ষ নেতা কারাগারে থাকায় নতুন নেতৃত্ব ঠিক করা হয়েছে। সবার সক্রিয়তা প্রমাণে রাজপথে নামার তাগাদা দিয়েছেন সিনিয়র নেতারা। গাজীপুর জেলার নেতৃত্ব নিয়েও অখুশি দলের সিনিয়র নেতারা। কঠোর ভর্ৎসনার পর অবরোধের শেষ দিনে কয়েক জায়গায় নেতাকর্মীকে নামানো সম্ভব হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
ঢাকা বিভাগের বাইরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বরিশাল বিভাগের। হরতাল কিংবা অবরোধে বরিশাল জেলা, মহানগর ছাড়াও অন্যান্য জেলার নেতাদের ওপর বিরক্ত সিনিয়র নেতারা। সতর্ক করার পর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীন ও বরিশাল দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান রাজপথে নেমে গ্রেপ্তার হন।
বিগত চার দিনের আন্দোলন কর্মসূচিতে কুমিল্লা বিভাগ নিয়েও দলের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। শুধু বিভাগ আর জেলা নয়, উপজেলা পর্যায়ের নেতাদেরও রাখা হয়েছে মনিটরের আওতায়। সাম্প্রতিক আন্দোলনে সক্রিয়তা দেখাতে পারেনি– এমন তালিকার শীর্ষে আছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী উপজেলায় কার্যত কোনো আন্দোলনই গড়ে ওঠেনি। উপজেলা বিএনপির সভাপতি কামরুল হুদা শুরু থেকেই ফোন বন্ধ করে গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে কর্মীদের অভিযোগ। উপজেলা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি জাকির হোসেন জানান, ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজপথ তাদের দখলে ছিল। আওয়ামী লীগ অবস্থান নিতেও ভয়ে থাকত। কিন্তু বর্তমান কমিটির দুর্বল নেতৃত্বের কারণে দৃশ্য পাল্টে গেছে। নিজেরা রাজপথে নামেন না, তাদেরও ডাকেন না।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘হাইকমান্ডের নির্দেশে নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সরকার ২৮ অক্টোবর বর্বরোচিত হামলা করে সে ভুল ভেঙে দিয়েছে। শুরুতে হামলা-গ্রেপ্তারের আকস্মিকতায় সবাই একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে এরই মধ্যে সব গোছানো হয়েছে। আগামীতে সবাই ঐক্যবদ্ধ শক্তি নিয়েই মাঠে থাকবে।’ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নিষ্ক্রিয় নেতাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সরাসরি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মনিটর করছেন। নিষ্ক্রিয়দের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। আশা করছি, লাগাতার আন্দোলনে সারাদেশেই নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবেন।’
সূএঃসমকাল অনলাইন।