কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় উঠে ডান দিকে যেতেই চোখে মিলল একটি ব্যানার। বড় বড় অক্ষরে তাতে লেখা—করোনা ওয়ার্ড। সামনেই বসেছিলেন দুজন তরুণ। দুজনই ছাত্রলীগের কর্মী। তাঁদের একজন শেখ সালমান। জেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে তাঁদের এ রকম ৩৫ জন স্বেচ্ছাসেবক দেড় বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে করোনা রোগীদের বিভিন্ন সেবা দিয়ে আসছেন। কুষ্টিয়ার করোনা রোগীরা হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে কেমন চিকিৎসা পাচ্ছেন, তা দেখতেই ভেতরে যাওয়া। এ কাজে সহযোগিতা করলেন সালমান। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ওয়ার্ডের সব জায়গা তাঁর চেনা হয়ে গেছে।বিশেষ সতর্কতার মেনে বৃহস্পতিবার সকালে ওয়ার্ডের ভেতরে যেতেই চোখে পড়ল পাঁচজন রোগী মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ওয়ার্ডের ভেতরে কয়েকটি কক্ষ। এর একটি কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা আছে। ওই কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, আবদুল বারিক নামে এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি দুটি বেডের মাঝে মেঝেতে বসে আছেন। আপনি কি রোগী? জবাব মিলল ‘না’। তিনি বলেন, ‘এই যে দেখছেন তিনটা বেডে তিনজন রোগী। এদের একজন হলো আমার স্ত্রী, বাকি দুজন মেয়ে। পরিবারের তিন সদস্যকে নিয়ে সাত দিন ধরে এই করোনা ওয়ার্ডে দিন কাটাচ্ছি। স্ত্রী নবিরন (৫০), দুই মেয়ে নূর জাহান (২৮) ও জান্নাতুল (১৮) বিছানায় শুয়ে আছে। এর মধ্যে নূর জাহানের অক্সিজেন চলছে।’
হাসপাতালে চিকিৎসাব্যবস্থা কেমন—জানতে চাইলে আবদুল বারিক বলেন, ‘ভালোই সেবা দেয়। ওষুধ পাওয়া যায়। চিকিৎসক ও নার্স সবাই আসেন খোঁজখবর নেন। তবে কবে বাড়ি যাব, সেই চিন্তায় ঘুম আসে না। পরিবারের তিন সদস্যকে সুস্থ করে দ্রুত বাড়ি ফেরার ইচ্ছে।’হাসপাতাল সূত্র বলছে, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ৩৬ শয্যার করোনা ওয়ার্ড। তবে এই ওয়ার্ডে এদিন রোগী ভর্তি ৪৭ জন। ওয়ার্ডের ভেতর অতিরিক্ত আরও কয়েকটি বেড নেওয়া হয়েছে। বাকিরা মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দশজনকে একসঙ্গে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহকরাযায়। শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা (এইচএফএনসি) রয়েছে ১৪টি
কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের কক্ষে ৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর নাম মোকাম্মেল হোসেন। তাঁকে সব সময় অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। বৃদ্ধের নাতি মাহবুব বিছানার পাশে বসে আছেন। তিনি বলেন, দাদার অবস্থা ভালো না। চিকিৎসকেরা চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে হয়তো দু–এক দিনের মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র নেওয়া হতে পারে।
কক্ষ থেকে বের হতেই দুজন নার্সকে রোগীদের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে দেখা গেল। এর একজন জেরিন আক্তার। জেরিন এক বছর ধরে এই করোনা ওয়ার্ডে কাজ করছেন। ছয় ঘণ্টার শিফটে কাজ শেষে তিনি আবার বাড়ি ফিরে যান। তবে করোনা ওয়ার্ডে কাজ করেও তিনি অবশ্য এখনো করোনায় আক্রান্ত হননি। কেমন বোধ করেন, জানতে চাইলে জেরিনের জবাব,‘নার্সেরচাকরি নিয়েছি সেবা দিতেই। সেটা করছি। তবে ভয় তো একটু থাকেই।’
এই ওয়ার্ডের আরও তিনটি কক্ষে ভর্তি রোগী সেবা নিচ্ছেন। তাঁদের কারও আত্মীয় এসে খোঁজখবর নিয়ে যান। আবার কেউ ফোনে খোঁজ নেন। ওয়ার্ডের সামনে এক ব্যক্তিকে পাওয়া গেল, নাম মাহবুব হাসান। তাঁর আত্মীয় আবদুল মান্নান করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি। বাড়িতে আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন সাপোর্ট দেন। এতে তিনি সুস্থ বোধ করেন। হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তিনি সন্তুষ্ট বলে জানান।
করোনা ওয়ার্ডের সামনে দিয়ে অন্যান্য ওয়ার্ডের যাওয়ার বারান্দা। এমনকি ওয়ার্ডের সামনের মেঝেতেও নন–কোভিড রোগী শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে তাঁদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাঁরাও এ নিয়ে কিছুটা ভয়ে থাকেন। এদিকে হাসপাতালে প্রতিদিনই আগের চেয়ে অধিক হারে রোগী ভর্তি হচ্ছে। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটু চিন্তিত। সকাল ১০টার দিকে করোনা ওয়ার্ডের সামনে হাজির হলেন তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মান্নান ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এ এস এম মুসাক কবির। করোনা ওয়ার্ড ‘পজিটিভ’ রোগীতে ভর্তি হওয়ায় আরেকটি ওয়ার্ড প্রস্তুত করছেন তাঁরা।