কুষ্টিয়ায় আবারও বেপরোয়া অপরাধে কিশোর গ্যাং
কুষ্টিয়া শহরে আবারও মাথাচারা দিয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধ। করোনাকাল থেকে আত্মপ্রকাশ এসব গ্যাং দ্বারা একাধিক চুরি ছিনতাই, মাদকাশক্ত, অপহরণসহ হত্যাকান্ডের মতো নানা অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ছোট ছোট দলে বিভক্ত এসব কিশোর গ্যাং একে অন্যের উপর হামলা পাল্টা হামলার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। অভিযোগ আছে এসব কিশোর গ্যাংকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মদদ যোগাচ্ছেন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকর্মীরা।
নিজেদের হীনস্বার্থ হাসিলে এসব কিশোরদের নানা ভাবে দলে টানছেন। মূলত যুব ও সিনিয়র ছাত্রনেতারা এই সব কিশোরদের তথাকথিত বড় ভাই। বার্থ ডে সহ বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানে এই সমস্ত বড় ভাইয়েরা এদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করে অর্জিত টাকা দিয়ে মদদ যুগিয়ে থাকে। বিনিময়ে নির্বোধ এসব কিশোর-কিশোরীরা বড় ভাইদের দল ভারী করে। আধিপত্য মাদকচক্রের সম্পৃক্ততায় হিরোইজম বোধে নিজেদের উপস্থাপন করতে গিয়ে কোমলমতি এসব শিশু শিক্ষার্থীরা পা বাড়াচ্ছে অন্ধকার অপরাধ জগতে। সাম্প্রতিক সময়ে শহরে বিভিন্ন এলকায় এসব সমবয়সীদের মধ্যে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনাও বেড়ে গেছে। সহজলভ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির নানা ডিভাইসে এ্যাপস ব্যবহার করে নিজেরা দ্রæততম সময়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
কেস স্টাডি: ০১. ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার বেলা সাড়ে বারোটার দিকে কুষ্টিয়া শহরতলীর হাটশ হরিপুর বাজারে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত জখমে গুরুতর আহত হয় আকাশ ও ইমন নামের দুজন কিশোর। এঘটনায় তামিম ইকবাল জয় নামক এক কিশোর কে আটক করে পুলিশ। আকাশ শালদহ গ্রামের আকমলের ছেলে ও ইমন একই এলাকার আলাউদ্দিনের ছেলে।
কেস স্টাডি: ০২. গত ১২ই নভেম্বর শুক্রবার বিকেল ৫ টার সময় শহরের থানাপাড়া এলাকার কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে পূর্ব শত্রæতার জের ধরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় রক্তাক্ত জখম হয় গ্যাং লিডার সজিব শেখ(২২)নামে এক যুবক। ঘটনার সময় প্রতিপক্ষ কিশোর গ্যাং জিবি গ্রæপের হৃদয়সহ সংশ্লিষ্টরা তাকে ডেকে নিয়ে হামলা চালায় বলে কুষ্টিয়া মডেল থানায় দেয়া লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়। আহত সজিব ছাত্র লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে নিশ্চিত করেন শহর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে।
কেস স্টাডি: ০৩. ১৫নভেম্বর দুপুরে কুষ্টিয়য় শহরের সাদ্দাম বাজার এলাকার বাসিন্দা চালকল মালিক লোকমান হোসেনের ছেলে সোহানকে (২২)কে অপহরণ করে আটকে রাখে কুখ্যাত কিশোর গ্যাং লিডার সজিবের নেতৃত্বে। পরে কুষ্টিয়া মডেল থানায় ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে সোহানের পিতার এমন অভিযোগের সূত্র ধরে মডেল থানার পুলিশ অভিযান চালিয়ে অপহৃত সোহানকে উদ্ধারসহ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আটক করে পুলিশ। যদিও কুষ্টিয়া মডেল থানার পুলিশের দাবি এটা অপহরণ নয়; পূর্ব থেকেই বিবদমান দ্বন্দের জেরে সোহানকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। তবে সোহানের পিতা লোকমান হোসেন পুলিশের এই দাবিকে নাকচ করে পাল্টা অভিযোগে বলেন, “এখানে মোটা অংকের টাকা লেনদেনের মাধ্যমে দফারফা হয়েছে বলেই ওদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোন এ্যাকশন নেয় নি।”
কেস স্টাডি: ০৪. ২০২০ সালের ৩জুলাই কুষ্টিয়া শহরের কুঠি পাড়ায় ফুটবল খেলা নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে তরিকুল ইসলাম নামের এক কিশোর কে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা।
কেস স্টাডি: ০৫. ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার সময় শহরের এন এস রোডে অবস্থিত কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের সামনে একটি হামলার ঘটনায় মজমপুরের হৃদয়(১৮) নামক এক কিশোর গুরুতর আহত হয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়। কিশোর গ্যংয়ের মধ্যে বিবদমান দ্বন্দের জেরে এ ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি।
কেস স্টাডি: ০৬. ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর হাউজিং অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র লাবিব আসলাম কে মারধোর করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেয় অপর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর পিতার করা মামলায় অষ্টম ও নবম শ্রেনীতে পড়–য়া ৪কিশোরকে গ্রেফতার করে আদালতে সৌপর্দ করেন পুলিশ। কুষ্টিয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক অরূপ কুমার গোস্বামী জামিন শুনানীকালে আদালতে উপস্থিত গ্রেফতার কিশোরদের পিতামাতা ও অভিভাবকদের চরম তীর্যক ভাষায় ভৎস্মর্না করে ভবিষ্যতে সন্তানদের অনুশাসনে শতর্ক হওয়ার শর্তে গ্রেফতার কিশোরদের জামিনাদেশ দেন বলে নিশ্চিত করেন ঘটনার সময় কর্তব্যরত কোর্ট জিআরও উপ-পুলিশ পরিদর্শক নকিব উদ্দিন।
এতে শহরের সচেতন মহল চরম উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কুষ্টিয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারী কৌশুলী এ্যাড: অনুপ কুমার নন্দী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, সব সময় সবক্ষেত্রে আইন দিয়ে সবকিছু হয়না। কোমলমতি এসব বাচ্চাদের যতদিন পর্যন্ত নিজের ভালো-মন্দের জীবনবোধ গড়ে না উঠবে ততদিন পর্যন্ত এদের সকল দায়-ই কার্যত: অভিভাবকদের উপর বর্তাবে। সন্তান জন্ম দেয়ার পর তাকে ভালো সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার দায় নিতে হবে তাদের। নচেৎ এজাতীয় অপরাধের ক্রমবৃদ্ধি চরম উদ্বেগের কারন হয়ে উঠবে।
কুষ্টিয়ায় শিশু অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বরত প্রবেশন অফিসার আরিফুল ইসলাম জানান, বর্তমানে জেলায় সংঘটিত অন্তত: ৪০টি শিশু-কিশোর অপরাধের ঘটনায় জড়িত শিশু-কিশোর কিশোরীদের নিয়ে কাজ করছি। অপরাধ সংঘটনের পর শিশু সুরক্ষা আইনের বিধিমতে, অভিভাবকদের সাথে সমন্বিত উদ্যোগে প্রদত্ত নির্দেশিকার আলোকে তাদের আইনী সহায়তাসহ সব রকম নার্সিং করা হচ্ছে।
কুষ্টিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ সাব্বিরুল আলম পুলিশের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ নাকচ করে বলেন, “কিশোর অপরাধের মতো স্পর্শকাতর ঘটনাগুলি নিয়ন্ত্রনে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের পিতা মাতা বা অভিভাবকরা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, তাদের কিশোর বয়সী শিশুরা কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে এবং মোবাইলসহ নানা ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে কি করছে ?”
অনুসন্ধান reporting