কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ স্থাপনে অনিয়ম
ফেঁসে যাচ্ছেন প্রধান অভিযুক্তসহ কর্মকর্তারা
তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর দুই নির্দেশ * একজনকে ওএসডি, দুজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা * জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধেও পুনঃতদন্ত * প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখতে একনেকে উঠছে সংশোধিত প্রস্তাব
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পে অনিয়মের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ফেঁসে যাচ্ছেন ওই সময়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। শুরুর দিকে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও এবার তেমনটি হচ্ছে না। অনিয়ম হয়নি বলে সে সময় যে কর্মকর্তা সনদ দিয়েছিলেন এবার তিনিও বাদ যাচ্ছেন না। ইতোমধ্যেই প্রধান অভিযুক্তকে ওএসডি করা হয়েছে। দুজনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে বিভাগীয় মামলা। অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় প্রক্রিয়াধীন। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি তদন্ত করেছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি। এ অবস্থায় কাজ শেষ করতে প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাব আগামী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপন হতে যাচ্ছে ।
এদিকে তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর একটি হলো-অভিযোগসমূহ প্রমাণিত হওয়ায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। অন্যটি হচ্ছে-অতীব জরুরি জনআগ্রহপূর্ণ এই প্রকল্পের কাজ দ্রুত নতুন জনবল দিয়ে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এখন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। একজনকে ওএসডি এবং দুজনের বিরুদ্ধে বিভাগী মামলা হয়েছে। একজন অবসরে যাওয়ায় সে অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ তালিকায় ২০১৬-১৭ সালে প্রকল্প পরিচালক ডা. ইফতেখার মাহমুদ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদ মো. কবির, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহীন মিয়াসহ এক কর্মকর্তার নাম আছে। এছাড়া আরও একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন-নতুন তদন্তের পর প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সেখান থেকে ফাইল আসার পর তা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তারা জানিয়েছে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সত্যিকার অর্থে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে অন্যরা এমন অনিয়ম করতে দ্বিধাবোধ করবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পটি শেষ করার জন্য এর সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের সুপারিশও করা হয় প্রতিবেদনে।
সূত্র জানায়, মূল প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে মোট ২৭৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে হাতে নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় একনেক। এরপর প্রথম দফায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। পরে ব্যয় বাড়িয়ে মোট ৬১১ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে এটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত (তিন বছর বৃদ্ধি) সময় বাড়িয়ে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী আনা হয়। দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর গত বছরের ১২ মার্চ পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৬৮২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুনে বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরে প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছিল। সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য ৫ জানুয়ারি উপস্থাপন করা হয় একনেকে। বাস্তবায়নের ধীরগতি দেখে ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রস্তাব অনুমোদন না দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। সেই নির্দেশ মেনেই তদন্ত কমিটির প্রধান আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী গত ১৭ জানুয়ারি প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশে বলা হয়, ২০০৮ সালের রেট শিডিউলের পরিবর্তে ২০১১ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী টেন্ডার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়। এতে আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলার বিচ্যুতি ঘটে। এর দায়ে প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ জানিয়েছে-এর আগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নির্মাণসংশ্লিষ্ট দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত করে। সেই কমিটির সুপারিশ মেনে কুষ্টিয়ার গণপূর্ত বিভাগের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদ মো. কবির এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহীন মিয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। পরে তাদের দুজনকেই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়া খুলনা জোনের সে সময়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জিএম কামাল পাশাকে এই অভিযোগের বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করা হয়।
এখন কমিটির সুপারিশ এবং প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত প্রস্তাবের আলোকে ওই দুই কর্মকর্তার (শাহীন মিয়া ও শহীদ মো. কবির) বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। একই সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. ইফতেখার মাহমুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, তিনি বর্তমানে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। তবে শাহীন মিয়া সর্বশেষ আইএমইডির সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটিকে লিখিত বক্তব্য দেন। এতে তিনি বলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়ে নকশা পরিবর্তন করায় প্রচলিত নিয়মনীতির কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু তদন্ত কমিটি বলেছে, ব্যত্যয় হয়েছে। এদিকে ইতোমধ্যেই কমিটির সুপারিশ মেনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব শহীদ উল্লাহ খন্দকার শনিবার বলেন, ইতোমধ্যেই প্রধান অভিযুক্ত মো. শাহীন মিয়াকে মাঠ পর্যায় থেকে নিয়ে এসে ওএসডি করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অপর দুজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যদি কেউ অবসরেও যান তাহলে সেই আইন মেনেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র :যুগান্তর (অনলাইন)