পাকিস্তানের সেজান জুস আমদানির মাধ্যমে ব্যবসায় হাতেখড়ি আবুল হাসেমের।পরবর্তী সময়ে এ তালিকায় যোগ হয় নসিলা, কুলসনসহ বিভিন্ন পাকিস্তানি ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য। নব্বইয়ের দশকে ব্যবসায় শুরুর পর আবুল হাসেমের বাণিজ্যিক পরিধি ছিল মূলত ট্রেডিংনির্ভর। কিন্তু ২০০৬ সাল পরবর্তী সময়ে নিত্যনতুন পণ্যের নাম যুক্ত হতে থাকে তার ব্যবসায়। আমদানির পাশাপাশি সেজান জুসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের উৎপাদক হয়ে ওঠেন তিনি। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণেই হঠাৎ করে ফুলেফেঁপে ওঠে আবুল হাসেমের ব্যবসা। ‘সজীব গ্রুপ’ নামে একটি ব্যবসায়িক ট্রেডমার্কও গড়ে তোলেন আবুল হাসেম।
এক দশক আগে সজীব গ্রুপের ব্যাংকঋণের আকার ছিল ৫০০ কোটি টাকারও কম কিন্তু গত এক দশকে গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায়। দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গিয়েছে শিল্প গ্রুপটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মে মাসে সজীব গ্রুপের ১১টি কোম্পানির নামে ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৯৩ কোটি টাকা ঋণ ছিল হাসেম ফুডস লিমিটেডের। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় উৎপাদন হতো ‘সেজান জুস’। যেখানে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ।
সজীব গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সজীব করপোরেশনের নামে ঋণ আছে ৩৬০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় রাজধানীর ফার্মগেট। আর হাসেম রাইস মিলস লিমিটেডের নামে ব্যাংকঋণ আছে ৩৩৮ কোটি টাকা চাল উৎপাদনের এ মিলের অবস্থান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়। সজীব গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হাসেম ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেডের নামে ২০১ কোটি, সজীব লজিস্টিকস লিমিটেডের নামে ৩৮ কোটি, সজীব হোমস লিমিটেডের নামে ২৯ কোটি, হাসেম এগ্রো প্রসেসিং লিমিটেডের নামে ২০ কোটি, হাসেম অটো রাইস মিলের নামে ৮ কোটি, স্যাভি ফুডস লিমিটেডের নামে ৩ কোটি ও মারস ইন্টারন্যাশনালের নামে ২১ লাখ টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে।
সিলেট মহাসড়কের পাশে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হাসেম ফুডস লিমিটেডের পাশে গ্রুপটির বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে। বহুতল এসব ভবনে সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে হাসেম ফ্লাওয়ার মিলসের অবস্থানও একই এলাকায়। সজীব গ্রুপের আটা, ময়দাসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য ও ফ্রুটস ড্রিংকস উৎপাদিত হয় ভবনগুলোতে। এর মধ্যে একটি ভবন ভস্মীভূত হওয়ায় গ্রুপটির অন্য ভবনগুলোতেও শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখেছেন।
আগুনে পুড়ে যাওয়া হাসেম ফুডস লিমিটেডে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ আছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। পুড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানে ঋণ আছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ইসলামী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্সের। এছাড়া গ্রুপটির অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ আছে প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ট্রাস্ট ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ অন্তত এক ডজন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের।
ভয়াবহ এ ঘটনার পর এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে গিয়েছেন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হাসেম, তার চার ছেলে হাসীব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম ও তানজীম ইব্রাহীম। এছাড়া গ্রুপটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহান শাহ আজাদ, উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ ও প্রকৌশলী মো. আলাউদ্দিনও গ্রেফতার হয়ে পুলিশি রিমান্ডে রয়েছেন।
এ রকম একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে সজীব গ্রুপকে ঋণ দেয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। উদ্বেগে রয়েছেন গ্রুপটিকে ঋণ দেয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তারাও।‘ব্র্যান্ড ইমেজ’ থাকায় গ্রুপটিকে দেয়া ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতও নেই ব্যাংকগুলোর হাতে। এ প্রসঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে আবুল হাসেম এতদিন সফলই ছিলেন। সজীব গ্রুপের প্রতিটি পণ্যের বাজার চাহিদাও ভালো ছিল। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা পুরো শিল্প গ্রুপটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একজন ভালো উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যদি ভঙ্গুর হয়, সেটি দুর্ভাগ্যের।
সেজান জুস উৎপাদনের পুড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ঋণ আছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের। ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে কারখানাটির যে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি, তা মেনে নেয়া যায় না। একটি শিল্পকারখানা নির্মাণঅনুমোদন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অনুমোদন লাগে। লাইসেন্স নবায়নের সময়ও কারখানা পরিদর্শনের বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয়। এত কিছুর পরও হাসেম ফুডসের যে পরিস্থিতি দেখছি, সেটি মেনে নেয়া যায় না। দেশের অন্যসব শিল্প-কারখানার পরিস্থিতিও ভিন্ন বলে মনে হয় না।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, চেয়ারম্যানসহ আটজন গ্রেফতার হওয়ার পর শিল্প গ্রুপটি পরিচালনা করার মতো কেউ নেই কারখানার ভবনসহ অন্যসব যন্ত্রপাতি হয়তো বীমার আওতায় আছে। কিন্তু প্রাণহানিসহ যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়ে গেল, সেটির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। এখন গ্রুপটি যদি দক্ষ হাতে পরিচালনা না হয়, তাহলে সব ক্ষতির প্রভাব এসে ব্যাংকের ওপর পড়বে।
সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হাসেম রাইস মিলস লিমিটেডে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংক এশিয়া প্রতিষ্ঠানটির নামে থাকা ৩৩৮ কোটি টাকার লিড অ্যারেঞ্জার হলো প্রাইম ব্যাংক। সজীব গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত হওয়ার পর অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ আদায় নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বণিক বার্তাকে বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে সফল একজন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এতটা পিছিয়ে থাকাটি আশ্চর্যের। সজীব গ্রুপের খাদ্যপণ্যগুলো বাজারে বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু গণমাধ্যমে যে ভয়ংকর চিত্র দেখলাম, তাতে গ্রুপটির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। সজীব গ্রুপের ভাগ্যের সঙ্গে অনেক ব্যাংকের ভালোমন্দও যুক্ত হয়ে গেছে। উদ্যোক্তাদের কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে দেখতে হবে।
উদ্যোক্তা হিসেবে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমের হাতেখড়ি মূলত পৈতৃক সূত্রে লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ বাজারে ‘আজিজ বিডি’ দিয়ে শুরু হয় তার পিতা ইব্রাহিম মিয়ার ব্যবসা। এরপর পাট, বস্ত্র, সুতা, অ্যালমিনিয়ামসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন ইব্রাহিম মিয়া। ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক খাতেও বিনিয়োগ ছিল তার। পিতার হাত ধরেই নব্বইয়ের দশকে ব্যবসায় হাতেখড়ি হয় আবুল হাসেমের। রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসন থেকে নির্বাচন করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।
সেজান জুসের বাইরে সজীব গ্রুপের আটা, ময়দা, সুজি, নুডুলস, সস, গুঁড়া মসলা, ইসবগুল, চিপস, পানীয়সহ বিভিন্ন ধরনের রেডিমিক্স পণ্য বাজারে রয়েছে ট্যাং, কুলসন, নসিলা, বোর্নভিটা ও ওরিওর মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে গ্রুপটি। ‘ওয়ান স্টপ’ নামে সুপারশপ ব্যবসাও রয়েছে সজীব গ্রুপের। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ওয়ান স্টপের আউটলেট। উইংস ক্লিয়ার লেমন ড্রিংক, হাল্ক এনার্জি ড্রিংক, আহা কোলা, ড্রিংকিং ওয়াটার, চকোলেটের মতো আরো বেশকিছু ব্র্যান্ড রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিপণনের তালিকায়। এছাড়া সজীব গ্রুপের বিভিন্ন পণ্য মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেপাল, ভুটান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় গ্রুপটি থেকে জানানো হয়।
এ প্রতিবেদন লেখার আগেই গতকাল সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম, তার চার ছেলেসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। এজন্য গ্রুপটির ব্যাংকঋণসহ ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে শুক্রবার দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের প্রাণহানির দায় সম্পর্কে জানতে চাইলে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম বলেছিলেন, মালিক হিসেবে এসবের দায় অবশ্যই আমার। তবে ঘটনাটি পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। অগ্নিকাণ্ডে যাদের মৃত্যু হয়েছে