কুষ্টিয়ায় আবারো এনআইডি জালিয়াত চক্রের দৌরাত্মে শংকিত হয়ে পড়েছে জমির মালিকরা। অভিযোগ উঠেছে রাজনৈাতিক প্রভাবশালীর মদদ, সাব রেজি: অফিসের মুহুরী দলিল লেখক ও অসাধু কর্মচারী কর্মকর্তারদের যোগসাজসেই চলছে এসব নির্বিঘ্নে। এরা যোগসাজসী দুর্বৃত্তায়ন চক্রের কুটকৌশলে জাল/ভুয়া এনআইডি ব্যবহার একের পর এক অন্যের জমির দাতা-গ্রহিতা বা ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল সম্পাদন করে যাচ্ছে। ইতোপূর্বে কুষ্টিয়ায় একাধিক এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হওয়ায় জেলা জুড়ে ব্যাপক চা ল্যের সৃষ্টি হয়। নড়ে চড়ে বসে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। প্রশাসনিক তৎপরতায় এই জালিয়াত চক্র কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিলেও আবারো এই চক্রটি খোলস পাল্টে নতুন করে জালিয়াতির ঘটনা ঘটাচ্ছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পূর্বের জালিয়াতির ঘটনায় ডজনাধিক মামলা হলেও সেসব মামলার দৃশ্যত: বিচারিক প্রক্রিয়ার কোন ইতিবাচক দৃষ্টান্ত না থাকায় সেগুলি বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এতে চরম ক্ষুব্ধ ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চেয়ে ঘুরছে দ্বারে দ্বারে।
সংশ্লিষ্ট কুষ্টিয়া জেলা রেজিষ্ট্রার অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইব্রাহিম হোসেন বলছেন, ‘শর্তানুযায়ী দলিল সম্পাদনের সময় দাতা-গ্রহিতারা যে এনআইডি আমাদের দেখায় তা আদৌ সঠিক কিনা বা জাল/ভুয়া কিনা তার যাচায় করার মতো তাৎক্ষনিক কোন ব্যবস্থা না থাকার সুযোগ নিয়ে একটি অসাধু চক্র একের পর এক জাল দলিল সৃষ্টি করছে। তবে জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের ওই কর্মকর্তার মন্তব্যকে নাকচ করে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবু আনছার বলেন, ‘এনআইডি যাচায়ের সুযোগ নেই’ বলে জেলা রেজিষ্ট্রী অফিসের ওই কর্মকর্তা দায় এড়িয়েছেন’। কুষ্টিয়াতে যে হারে এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে তাতে ছোট্ট একটা ডিভাইস হলেই এনআইডি যাচায় করা সম্ভব’।
সরোজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, এবছরের ফেব্রæয়ারীতে কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিস্ট্রার অফিসে জাল এনআইডি নং ৬৪০২৬৬৯৪০৯ ও আমমোক্তারনামা দলিল নং ১১২১২/২০১৭ ব্যবহার করে কুষ্টিয়া শহরের প্রায় দুই কোটি টাকার ভু-সম্পত্তি হস্তান্তরে ২৭ লক্ষ টাকার একটি দলিল রেজিস্ট্রি হয় যার নং ১৭৯৪/২০২৩।
অনুসন্ধানকালে কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্ট্রী অফিসের রেকর্ড কিপার সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে সৃষ্ট ওই আমমোক্তারনামা দলিল সৃষ্টির সমর্থনে কোন প্রকার যাচায় করন কাগজপত্র সংযুক্ত নাই এবং জালিয়াতির অভিযোগে বিচারাধীন মামলা থাকায় ওই দলিলও আদালতের আদেশে জব্দ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। তাছাড়া ওই আমমোক্তারনামা দলিল জাল বা ভুয়া বলে ইতোপূর্বে দলিল দাতাগণ জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতারাবস্থায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এরপরও ওই দলিলের সূত্র ধরে কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডের বাসিন্দা মৃত: এমএম আব্দুল হাকিমের পুত্র এমএম আব্দুল ওয়াদুদ গং এর পৈত্রিক ভু-সম্পত্তি জালিয়াতি করে দলিল রেজিষ্ট্রি করে নিয়েছে ওই চক্রটি।
এবিষয়ে সদর সাব-রেজিষ্ট্রী অফিস চত্বরের দলিল লেখক নাসির উদ্দিন লাইসেন্স নং ১০৯ এর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘গত ফেব্রæয়ারীর ১৫ তারিখে সহকারী দলিল লেখক শরিফুল ইসলাম সোহেল আমার কাছে একটা দলিলে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। এধরণের ঘটনা আমাদের এখানে খুব স্বাভাবিক হিসেবেই হয়ে থাকে। কিন্তু এই এরমধ্যে এতো জটিলতা ছিলো সে সময় আমি বুঝতে পারিনি।
সহকারী দলিল লেখক সোহেল জানায়, ‘এই দলিলের গ্রহীতা মিস শেফালী খানমের স্বামী মো: মারজুম খাঁন নিজেই ওই দলিল অন্যকোন লেখকের কাছ থেকে লিখা সম্পন্ন করে আমার কাছে এসে বলে, ‘তুমি শুধু দলিল লেখক হিসেবে সাব রেজিষ্ট্রারের কাছে পেশ করবা, বাদ বাকী সবাইকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার’। সেজন্য তোমাকে ১০হাজার টাকা দেবো বলে আমার সাথে মিটমাট হয়’।
তবে এবিষয়ে কথা বলতে দলিল দাতা কুষ্টিয়া শহরের উত্তর লাহিনী এলাকার বাসিন্দা মৃত: আবুল হোসেনের ছেলে মো: দেলোয়ার হোসেন এনআইডি নং ৬৪০২৬৬৯৪০৯ (দলিলে ব্যবহৃত) কে মুঠোফোনে কল করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
দলিল গ্রহিতা মিস শেফালী খানম এর সেল ফোন ০১৭১০৩১৯৪২৬এ কল দিলে বিজি পাওয়া যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই তার স্বামী মো: মারজুম খাঁন কলব্যাক করে প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আপনি কি শেফালী খানমকে চিনেন ? দলিলে দেয়া ঠিকানাটা ভালো করে দ্যাখেন, উনি সেখ সেলিমের বোন, আপনার এ্যাতো স্পর্ধা ? আপনি ওই দলিল নিয়ে টানাটানি করছেন ? আপনি একসাথে দুইটা মিডিয়াতে কিভাবে কাজ করেন সেটাও দেখা হবে’।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) দবির উদ্দিন উল্লেখিত ১৭৯৪/২৩ নং দলিলটি জাল বলে আব্দুল ওয়াদুদের অভিযোগের পরিপেক্ষিতে ওই দলিলে তফশিলভুক্ত জমির নামজারি প্রক্রিয়া স্থগিত করে রাখা হয়েছে বলে জানান।
কুষ্টিয়া জেলা নির্বাচন অফিসার মুহাম্মদ আবু আনছার বলেন, ‘গত ১৫ ফেব্রæয়ারীতে কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্ট্রী অফিসে সম্পাদিত দলিল নং ১৭৯৪/২০২৩ এর দাতা দেলোয়ার হোসেন তার নামের পাশে ব্যবহৃত এনআইডি নং ৬৪০২৬৬৯৪০৯ এর কোন বৈধ ডেটা নির্বাচন কমিশনের তালিকায় নেই’।