অনিয়ম ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় পর্যায়ের প্রথম সংশোধিত প্রকল্পের ৫শ ৩৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে অনুমোদন পাওয়া চলমান অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি নানা অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৮ সালে অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৭% অগ্রগতির মধ্যেই নির্মান মেয়াদের ৪ বছর শেষ হচ্ছে এবছরের ২২ডিসেম্বরে। চলমান এই উন্নয়ন প্রকল্পের এমন দৈন্য দশার জন্য নির্মাণ সামগ্রীর উর্দ্ধমুখী বাজার মূল্যকে দুষচেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান; অন্যদিকে কল্পনা প্রসুত হলেও প্রকল্পের বাকী ৮৩% কাজ বাস্তবায়নে ব্যয়বৃদ্ধি ছাড়াই বর্ধিত সময় চান ইবি প্রকৌশল বিভাগ। অভিযোগ আছে এই দৈন্যদশা উত্তোরনের পক্ষে বিপক্ষে দুই ভাগে বিভক্ত ইবি প্রকৌশল বিভাগ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কৌশলে আশ্রয় নিচ্ছেন দুর্বৃত্তায়নের। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন ইবি প্রকৌশল বিভাগ।
উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নে নির্ধারিত ৪ বছরে অগ্রগতির ১৭% এ আটকে গেছে। পরিকল্পনা বিভাগ বলছে সময় মতো প্লানিং ড্রয়িং ডিজাইন সম্পন্ন করে দরপত্র প্রক্রিয়াসহ কার্যাদেশ চুক্তির সম্পন্নকরনে অদক্ষতার কারণেই প্রকল্পের নির্মান শুরুতে বিলম্ব। এছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগের কোন সমন্বয়হীনতা ছিলো কিনা সেবিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে নির্ধারিত অভিন্ন প্লানিং ড্রয়িং ও ডিজাইনে ১৪টি ১০তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মানে একাধিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ইবি প্রকৌশলী বিভাগ। কিন্তু প্রকল্প বাস্তয়নে সংশ্লিষ্ট ইবি প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা সমন্বয়হীন আচরণের কারণে থমকে যায় নির্মান কাজের গতি। সর্বশেষ প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি না করার শর্ত মেনে প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও ২বছর মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রনালয়ে পত্র প্রেরণ করেছে ইবি প্রকৌশল বিভাগ।
ইবি ক্যাম্পাসের উত্তরাংশে শিক্ষক আবাসনের জন্য ৬হাজার ৫শ বর্গফুটের ফ্লোর ও ১০তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মান কাজে চুক্তিবদ্ধ হোসেন কন্স্ট্রাকশন লি:। এখানে ফোরম্যান মিজানুরের অভিযোগ, ‘একই জমিনে পাশাপাশি অনেক গুলি ১০তলা ভবন নির্মান প্রকল্প চলছে। আমাদের কোম্পানী নির্ধারিত ড্রয়িং ও প্লানিং অনুযায়ী প্রি-কাষ্ট পাইলিং এ ৫০ফুট গভীরে স্থাপন করেছে। অথচ পাশেই অন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তারাও ১০তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মানে প্রি-কাষ্ট পাইলিং এ ৩৫ থেকে ৩৮ ফুট গভীরে স্থাপন করছে। এই ধরনের বৈষম্যকে মানতে না চাওয়ায় কয়েকদিন আগে একজন ভালো ইঞ্জিনিয়ারের বদনাম রটিয়ে তাকে এই ক্যাম্পাস থেকেই বের করে দিয়েছে। একটা বিল্ডিং টিকে থাকার মূল ভিত্তিই হলো এই প্রি-কাষ্ট পাইলিং। এখানে হেরফের হলেই সেই বিল্ডিং হবে চরম ঝুকিপূর্ন’।
এছাড়া ক্যাম্পাসের পশ্চিমাংশে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এমসিপিএল কন্সট্রাকশন প্রা: লি: প্রায় ৩২ হাজার বর্গফুট ও ১০বিশিষ্ট নির্মানাধীন বহুতল একাডেমিক ভবনের কাজ করছে। এখানকার প্রি-কাষ্ট পাইল ড্রাইভার বকুল মিয়া জানায়, ‘আমরা বিভিন্ন প্রজেক্টে সব ধরনের বহুতল বিশিষ্ট ১০তলা ভবন নির্মানে বেজমেন্ট প্রি-কাষ্ট পাইলিং নূন্যতম ৫০ফিট গভীর পর্যন্ত করেছি। সয়েল টেষ্টের ভিত্তিতে কোথাও কোথাও ১শ বা তারও অধিক দৈর্ঘের পাইল স্থাপন করেছি। কিন্তু এখানে আমরা ৩৮ফিট দৈর্ঘের পাইল স্থাপন করছি। এখানকার ইঞ্জিনিয়ার স্যারেরা যেভাবে বলছেন আমরা সেভাবেই কাজ করছি’।
বর্তমান নির্মান সামগ্রীর উর্দ্ধমুখী বাজার মূল্যের প্রেক্ষিতে এই প্রকল্প শেষ করতে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগ এবং নির্মানকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটা সমন্বয় করে অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে হবে বলে দাবি করেন মাইসা কন্সট্রাকশনের সাইট ইঞ্জিনিয়ার মুন্না আহম্মেদ। একই সাথে এসব কাজ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ইবি প্রকৌশল বিভাগের মধ্যে বিদ্যমান আন্ত:কোন্দলের অবসান জরুরী বলেও জানান তিনি।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এমসিপিএল’র নিজস্ব সাইট ইঞ্জিনিয়ার মুন্না আহম্দে জানায়,‘৩২হাজার বর্গফুটের ১০তলা একাডেমিক ভবনের কার্যচুক্তি মূল্য ৭০ কোটি টাকা, ৮হাজার বর্গফুটের ১০তলা শেখ রাসেল হল কার্যচুক্তি মূল্য২১ কোটি টাকা এবং প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার বর্গফুটের ১০তলা ছাত্রহল-২র কার্যচুক্তি মূল্য ৪৮ কোটি টাকা। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মাইসা কন্সট্রাকশন লি: বা এমসিপিএল কর্তৃক নির্মানাধীন তিনটি প্রকল্পেই ৩৫ থেকে ৩৮ ফিট লম্বা প্রি-কাষ্ট পাইলিং ব্যবহার করা হচ্ছে যা এধরনের বহুতল ভবনের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারন হলেও বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশনাতেই হচ্ছে বলে জানালেন এই সাইট ইঞ্জিনিয়ার।
ক্যাম্পাস জুড়ে চলমান নির্মানাধীন প্রকল্পের মাত্র ১০% অগ্রগতির কথা স্বীকার করে কাজের ধীর গতির কারণ হিসেবে বাজার মূল্যকেই দায়ি করলেন ইবির প্রকৌশল বিভাগের সাইট ইঞ্জিনিয়ার উপসহকারী প্রকৌশলী রাশিদুল ইসলাম।
তবে সকল অভিযোগ কে নাকচ করে সবকিছু ঠিক ঠাক ভাবে চলছে বলে দাবি করে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মুন্সী শহীদ উদ্দিন মো: তারেক বলেন,‘অভিযোগ যে কেউ করতেই পারে, সেটা প্রমান করুন। এছাড়া প্রকৌশল বিভাগের কোন সহকর্মীর সাথে কোন দুরত্ব নেই’ চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে কোন অনিয়ম বা দূর্নীতি হয়নি’ বলে দাবি করে জানান, ‘নির্মান সামগ্রীর উর্দ্ধমুখী মুল্যের কারণে ঠিকদাররা কাজ করতে গড়িমসি করছে। প্রকল্পের অগ্রগতি সর্বশেষ ১৭% হলেও বাকী কাজ শেষ করতে ব্যয় না বাড়িয়ে আরও দুই বছর সময় চেয়ে মন্ত্রনালয়ে পত্র প্রেরণ করেছি’।
তবে বিশ^বিদ্যালয়ের পরিকলপনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক নওয়াব আলী খান জানালেন, ‘যে কোন মূল্যে প্রকল্পের কাজকে ব্যহত করতে পারে এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকলে অবশ্যই তা তদন্ত করে উদ্ঘাটন করা হবে এবং কারো কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবে’।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে ৫শ ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ইসলামী বিশ্বিবদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি ছিলো একটি মেগা প্রকল্প। শুরু থেকেই নানা অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও দূর্নীতির মধ্যদিয়ে প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেয়া, বিলিং পদ্ধতির আড়ালে অর্থ আত্মসাৎসহ এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে মোটা অংকের টাকায় ছাত্রলীগের পদ কেনাবেচা, প্রকৌশল বিভাগের সব কর্মকর্তাকে দূর্নীতিগ্রস্তকরণে হুমকি ভয় ভীতি ও চাপ সৃষ্টির অভিযোগ উঠে বিশ^বিদ্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যা উত্তোরনে একাধিক তদন্ত কমিটি করলেও অদ্যবধি কোন তদন্তই আলোর মুখ দেখেনি বলেই উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতিতে এমন দৈন্যদশায় মুখ থুবরে পড়েছে।