‘লাইব্রেরি’ শব্দের মনস্ত¡াত্বিক আবহে চোখে পড়বে সাজানো গোছানো বইয়ের তাক, চুপচাপ পরিবেশ, আর নিঃশব্দে বই পড়া। চাইলে কোনো বই খাতায় এন্ট্রি করে বাড়িতে গিয়ে পড়া। তৃণমূল কৃষকের নাগালে এর সবটুকুই সহজ সাধ্য করার পাশাপশি ‘কৃষকের বাতিঘর’ নামক লাইব্রেরীর আরও একটি বিশেষ দিকের মাত্রা যুক্ত করেছে, তা হলো- এ লাইব্রেরিতে মানুষ যতটা আসে, তার থেকে বেশিমাত্রায় লাইব্রেরিই চলে যায় এলাকার কৃষক পবিারের কাছে।
এমন ব্যাতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলাতে অবস্থিত ‘কৃষকের বাতিঘর’ নামক লাইব্রেরী। দীর্ঘদিন ধরে এমন পাঠক বান্ধব কাজ করে যাচ্ছে এলাকার জ্ঞানপিপাসু মানুষদের জন্য। বিশেষ করে নিরক্ষর কৃষকদের উন্নয়নে রাখছে বিশেষ ভূমিকা।
সরেজমিন লাইব্রেরিটির কার্যক্রমে দেখা যায়, তারুন্যে উদ্দীপ্ত একদল তরুণ/তরুনীদের নিয়ে গঠিত গ্রন্থাগারের স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্যরা গ্রামের কৃষকদের কাছে, এমনকি মাঠে কর্মরত চাষীদের কাছে গিয়ে তাদের বই পড়ে শুনিয়ে তাদের না জানা কৃষি বিষয়ক ধারণার পথকে সুগম করছে। সেখানে চাষের আধুনিকতা, জীবনমান উন্নয়নের গল্প, সাহিত্য, ভ্রমণসহ নানাবিধ বিষয়ে। এছাড়া গ্রামীণ নারীদের উন্নয়নেও একই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে এ গ্রন্থাগার। যা জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করছে গ্রামের চাষি এবং সাধারণ মানুষদের।
‘কৃষকের বাতিঘর’ লাইব্রেরির উদ্যোক্তা এবং সাধারণ সম্পাদক হোসাইন মোহাম্মদ সাগর জানান, দেশ এগিয়ে গেলেও আমাদের গ্রামের কৃষকরা এখনো অনেক পিছিয়ে। এ পিছিয়ে পড়া কৃষকদের উন্নয়নের জন্যই আমাদের এই কার্যক্রম। আমাদের একটি সংগঠনও আছে একই নামে। এ লাইব্রেরি এবং সংগঠনের মাধ্যমে আমরা কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক চর্চা, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলার উন্নয়ন, মানবিক মূল্যবোধ উন্নয়ন, কৃষকদের আধুনিক চাষে উদ্বুদ্ধ করা ও চাষাবাদ সংক্রাস্ত যে কোনো প্রয়োজনে সহযোগিতা করা, গ্রামের নারীদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা, কৃষক-নারী ও শিশুদের উন্নয়নসহ গ্রামীণ জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্নভাবে উন্নয়নমূলক সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ভূমিকা পালনের চেষ্টা করি। এটি সম্পূর্নরূপে অলাভজনক এবং স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্ধুদ্ধকরনের একটি দৃষ্টান্ত।
‘কৃষকের বাতিঘর’ সকলের জন্যই উন্মুক্ত হলেও কৃষকরাই এখানে অগ্রাধিকার বিবেচিত। এছাড়া প্রান্তিক ও তৃণমূল জনপদের শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করা, নেতৃত্ব শেখানো। স্বেচ্ছাসেবকরা কৃষকদের বই পড়ে শোনানের পূর্বে নিজেরাই বইটি ভালো করে পড়ে নেন যাতে বইটি পড়ে কৃষকদের ভালোমতো বোঝাতে পারেন। এদিক থেকে তাদের উন্নয়নটাও অনেক বেশি। যেসব তরুণ/তরুনী স্বেচ্ছাসেবক সদস্য যতবেশি সহজসাধ্য করে বই পড়ে শোনাতে পারে, তাদের অধিক উৎসাহ যোগাতে মাঝেমধ্যে পুরস্কার দেয়া হয়।
লাইব্রেরির স্বেচ্ছাসেবক কলেজ শিক্ষার্থী জিনিয়া ইসলাম বলেন, আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষক এবং গ্রামের নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে বই পড়ে শোনাই, বিশেষ করে যারা নিরক্ষর। তাদের যে জানার কত আগ্রহ, কত প্রশ্ন, সেগুলোর উত্তর দিতে পারলে, সঠিক তথ্য জানাতে পারলে আমাদের ভালো লাগে। আর এগুলো করতে গিয়ে আমরা যারা স্বেচ্ছাসেবক আছি, তারাও নতুন নতুন অনেক কিছু জানতে পারি। ভালো কাজের কাজের জন্য লাইব্রেরি থেকে বই উপহার পাই। আমাদের জন্য এটা খুবই আনন্দের।
সুবিধাভোগী কৃষক এবং লাইব্রেরির সদস্য মো. ইয়াসিন বলেন, এ লাইব্রেরির কাজের ফলে আমরা এখন অনেক কিছু সহজেই জানতে পারি। যেমন আগে ফসল চাষ করতাম বাপ-দাদার কাছ থেকে শেখা পদ্ধতিতে। কিন্তু এখন লাইব্রেরির আপা-ভাইয়ারা আমাদের নতুন নতুন চাষাবাদেরর কৌশল সম্পর্কে জানতে পারছি। এতে ফসল ভালো হয়। আর মাঝে মধ্যে গান-কবিতা-গল্পও শোনান, আবার পুরস্কারও দেন।
যুবসমাজকে সুস্থ সুন্দর জীবন দিতে হলে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বই পারে একটি সুন্দর সমাজ দিতে। কৃষকের বাতিঘর লাইব্রেরির মাধ্যমে সেই কাজটি যেমন খুব সুন্দরভাবে হচ্ছে, ঠিক তেমনি লাভবান হচ্ছেন কৃষকরাও। কেননা তারা পড়তে না পারলেও এ লাইব্রেরির মাধ্যমে জানতে পারছেন প্রয়োজনীয় চাষ পদ্ধতিসহ অন্যান্য নানান বিষয়।