ক্রেতারা বাজার থেকে প্রতিদিন ভেজাল চাল কিনে প্রতি কেজিতে ঠকছেন ১৫ থেকে ২০ টাকা। পছন্দের চিকন/সরু চাল ক্রয় করতে গিয়ে ক্রেতাদের পকেট থেকে খসছে বাড়তি এই টাকা। ভোক্তাদের পকেট থেকে চিকন/সরু চালের টাকা নিয়ে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে মূলত মোটা চাল। তথ্যানুসন্ধানে এমন তথ্যের সত্যতা স্বীকার করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিএডিসি, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, খাদ্য বিভাগ, কৃষিবিদ, পুষ্টি বিশেষজ্ঞ, কৃষক, চালের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা এবং ভোক্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই সত্য বেরিয়ে এসেছে। অভিযোগের তীর চালকল মালিকদের দিকে।
চাল শ্রেণি বিন্যাসে বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্যমতে, ৩ এমএম থেকে ৬ এমএম লম্বা সাইজের চালগুলি মোটা বা মাঝারি মোটা শ্রেণিভুক্ত, ৬ এমএম থেকে তদুর্ধ পর্যন্ত লম্বা হলে চিকন/সরু, ৬.৫ এমএম থেকে ৭ এমএম বা তদুর্ধ পর্যন্ত লম্বাসহ সুগন্ধিযুক্ত হলে সেটা সরু বা অ্যারোমেটিক শ্রেণিভুক্ত। তবে লম্বায় ৩ এমএম সাইজসহ সুগন্ধি হলে সেটাকে অ্যারোমেটিক শ্রেণিভুক্ত বলা হয়। যেমন চিনিগুড়া, কালিজিরা বা এজাতীয় অন্যান্য সুগন্ধিযুক্ত চাল। সেখানে আরও বলা আছে কিছু জাতের চাল আছে যেগুলি ৬ এমএম লম্বা কিন্তু পার্শ্বস্ত মাপ ২ এমএমর উর্দ্ধে তাহলে সেগুলি মোটা বা মাঝারি মোটা বা মাঝারি চিকন জাতের শ্রেণিভুক্ত। অর্থাৎ চিকন/সরু চাল হিসেবে গণ্য করার ক্ষেত্রে তার সাইজ হতে হবে চালটি লম্বায় যতটুকু হবে তার পার্শ্বস্ত মাপ তিন ভাগের পৌনে একভাগ হতে হবে। সরু চালের সাইজ অনুপাত হবে ৩.৫:১ এবং সেটা অবশ্যই ধান থেকে খোসা ছাড়ানো অবস্থায়।
যে কোন ভোক্তা বাজারের চিকন/সরু চালের ব্যাগ থেকে সংগৃহীত নমুনা স্লাইড ক্যালিপাস ব্যবহার করে পরীক্ষা করলেই চাল ভেজালের সত্যতা খুব সহজেই পেতে পারেন। দেখা যাবে একই ব্যাগের মধ্যে বিভিন্ন সাইজের চালের মিশ্রণ রয়েছে। এসব চালগুলি ক্রেতারা চিকন/সরু চালের দাম দিয়ে কিনে এনে বাসা বাড়িতে রান্নার পর দেখা যাবে ভাত মোটা বা ফেটে যায়। মূলত এগুলি সবই মোটা বা মাঝারি মোটা বা লম্বা-মোটা চালকে কাটিং এবং পলিশ করে চিকন/সরু চালের দামে বিক্রয় করে ভোক্তা ঠকানো হচ্ছে যা নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর পঞ্চম অধ্যায়ে ৩১ ও ৩২ ধারার সুস্পষ্ট লংঘন। অথচ চিকন/সরু বা অ্যারোমেটিক চাল রান্নার পর এ জাতীয় সাইজ অ্যান্ড সেইফ, স্বাদ ও ঘ্রানের তারতম্য ঘটবে না; আনুপাতিক হারও বজায় থাকবে।
দেশে চাল ক্রেতারদের শীর্ষ পছন্দের চালগুলির মধ্যে রয়েছে- মিনিকেট, আটাশ, কাজল লতা। মিলাররা বিভিন্ন জাতের মাঝারি মোটা, লম্বা মোটা মাঝারি চিকন জাতের ধান সংমিশ্রণে কল্পিত ও বহুল পরিচিত ব্র্যান্ড মিনিকেট নাম ব্যবহার করে বাজারে ছাড়ছেন। ব্রি-২৮ এটা মাঝারি চিকন জাতের যা মোটা চালেরই শ্রেণিভুক্ত। ফলন কম হওয়ায় এক সময়ের অধিক জনপ্রিয় পাইজাম ধানের চাষ এখন বিলুপ্তির মুখে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে কাজল লতা যা সুবর্ণ লতা, স্বর্ণলতা বা স্বর্ণ জাতের ধান থেকে মিলাররা উৎপাদন করে বাজারে কাজল লতা ব্র্যান্ড নাম দিয়ে ছাড়ছেন। এর সবগুলি জাতই মোটা বা মাঝারি মোটা বা মাঝারি চিকন জাতের। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসব জাতের চালগুলিও মোটা চালের শ্রেণিভুক্ত। তাহলে কেন একজন ভোক্তা প্রতি কেজি চাল কিনতে ১৫ বা ব্র্যান্ডভেদে ২০ টাকা বেশি দিয়ে কার্যত: চিকন/সরু নামে মোটা চাল নেবেন?
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, দেশে উৎপাদিত মোট চালের ৮৫ শতাংশই মোটা, মাঝারি মোটা, লম্বা মোটা ও মাঝারি চিকন জাতের উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ও হাইব্রিড ধান থেকে এসেছে। সেকারণে সরকারি ভাবে চালের মূল্য নির্ধারণে মোটা চালের মূল্যকে বিবেচনায় নেয়া হয়। কৃষি বিপনন অধিদপ্তর কর্তৃক বিভাগ ওয়ারি মোটা চালের কেজি প্রতি ৩৬ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা আছে। সরকারি চাল ক্রয়ের ক্ষেত্রেও এই নিয়মই প্রতিপালিত হয়। কিন্তু চালের বাজারে এসব বাস্তবতার সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র বিদ্যমান।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অন্যতম বিবেচিত খাত হিসেবে জাতীয় খাদ্যনীতি পরিকল্পনায়- সকল নাগরিকের নির্ভরযোগ্য ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে তিনটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সরকার সিআইপি-১ ইতোমধ্যে সম্পন্ন ও বাস্তবায়ন করেছে। লক্ষ্য ছিল- নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের পর্যাপ্ত যোগান ও সরবরাহ, ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সবার জন্য খাদ্যপ্রাপ্তির সক্ষমতা এবং নারী ও শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিতকরণ। এই লক্ষ্য অর্জনে ইতোমধ্যে যুগান্তকারী সফলতার কারণে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয় উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশে পরিণত হয়েছে।
এতদসত্ত্বেও দেশের এই উদ্বৃত্ত খাদ্য প্রবাহের সুবিধাভোগী হতে পারছে না সরাসরি জড়িত উৎপাদক কৃষক ও ভোক্তাগণ। কৃষক মাঠ থেকে ধান ঘরে তোলার প্রাক্কালে ধানের দাম পাচ্ছেন না। মিলারদের বেধে দেয়া দামে ধান বিক্রি করেতে হচ্ছে কৃষককে। বাধ্য হয়ে পরবর্তী মৌসুমে ধান রোপনের প্রস্তুতি নেয়ার টাকা যোগানে মিলারদের বেধে দেয়া কমদামে ধান বিক্রি করছে। অথচ ঠিক যে মুহূর্তে কৃষক তার ঘরের ধান বিক্রয় শেষ করে ফেলছেন সেই মুহূর্তেই ধানের বাজার দর উর্দ্ধমুখী হয়ে যাচ্ছে মিলার ও মজুতদারদের কারসাজিতে।
গত পাঁচ বছরে দেশে চাল উৎপাদনের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন এবং সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়। এতে দেখা যায় দেশের ১৬ কোটি মানুষের শুধু চালের চাহিদা মাফিক (প্রতি একজনের ৪৮৭ গ্রাম হিসেবে) কেবলমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণই নয় ২ কোটি ৮৪ লক্ষ ৪০ হাজার ৮ শ মেট্রিক টনের চাহিদা মিটিয়ে ৭৮ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫ শ ৩৬ মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, দেশে সর্বমোট উৎপাদিত চালের ৯১ ভাগই ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল বা উফশী জাত ৮০টি এবং ৬টি হাইব্রিডের মধ্যে বহুল আবাদি প্রায় ৭০টি জাতের ধান থেকে প্রাপ্ত। এর মধ্যে ১০/১২টি জাতের ধান থেকে মোট উৎপাদিত চালের ১৫% ভাগ চিকন/সরু বা অ্যারোমেটিক চালের যোগান আসে। যেহেতু দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল, সে কারণে আমাদের বিজ্ঞানীরাও চাল থেকে যাতে সর্বোচ্চ পুষ্টি আসে সে বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করে তা অবমুক্ত করে দিয়েছেন কৃষকদের জন্য। প্রান্তিক মানুষ এখন ভাত থেকে নানা পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারেন।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের কৃষি শুমারি সূত্রে, দেশে মোট খানা পরিবার সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লক্ষ ৯৫ হাজার ৭ শ ৬৩-এর মধ্যে কৃষিভিত্তিক খানা পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৫১ লক্ষ ৮৩ হাজার ১ শ ৮৩ এবং কৃষি বহির্ভুত খানা পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ১২ হাজার ৫ শ ৮০। পরিসংখ্যান সূত্রমতে, ২০০৮ এবং তৎপূর্ব ১৯৯৮ সালের কৃষি শুমারির মধ্যবর্তী সময়কালে কৃষিভিত্তিক খানা পরিবারে সংখ্যা হ্রাস এবং কৃষি বহির্ভুত খানা পরিবারের সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগ হারে ক্রমবৃদ্ধির লক্ষণ হিসেবে বর্তমান দেশে কৃষি বহির্ভুত খানা পরিবারের সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়েছে। এসব কৃষি বহির্ভুত পরিবারগুলিই মূলত চাল বাজারের চাল ক্রেতা। প্রতি একটি পরিবারে গড়ে ৪ সদস্য ধরলে হিসেব মতে সারা দেশের ৮ কোটি মানুষই কৃষি বহির্ভুত খানা পরিবারের সদস্য এবং তারা সবাই চাল বাজারের ভোক্তা। এসব চাল ভোক্তারা প্রতিদিন বাজার থেকে প্রায় ৩৯ হাজার মেট্রিক টন চাল কিনে খাচ্ছেন।
এসব চালের যোগান আসছে দেশের বিভিন্ন চালের মোকাম থেকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোকাম হলো- নওগা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়ার খাজানগর। ২য় বৃহত্তম চাল মোকাম খাজানগর চালকল মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীনের দাবি দেশের চাল বাজারের ৩০ শতাংশ চাল খাজানগর থেকে সরবরাহ করছেন। প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন চাল দেশের বিভিন্ন জেলার চাল আড়তে যাচ্ছে। বর্তমানে চাল ক্রেতাদের চাহিদা মতো চিকন/সরু চালের ব্র্যান্ড মিনিকেট উৎপাদন করে বাজারে দিচ্ছেন তারা। এর থেকে তিনগুণ বেশি চাল সরবরাহ করছে সর্ববৃহৎ চালের মোকাম নওগাঁ ও দিনাজপুর থেকে বলেও জানান তিনি।
চালের বাজারের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা অভিন্ন সুরে বলছেন, বর্তমান চাল ক্রেতারা সবাই চিকন চাল কিনছেন। প্রান্তিক শ্রমজীবী থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের ক্রেতাদের চিকন বা সরু চাল পছন্দ। কুষ্টিয়া বড় বাজারে চালের আড়ৎ মালিক রাজু আহমেদ বলেন, সারাদিন খুচরা বিক্রেতাদের কাছে যে চাল বিক্রি হচ্ছে তার ৯০ ভাগই চিকন চাল। আমরাও খরিদ্দারের চাহিদা মতো চালের মোকাম থেকে চিকন/সরু চাল আমদানি করছি। মিলাররাও ক্রেতার পছন্দ মতো ১০, ২৫ বা ৫০ কেজি ওজনের প্যাকেট করে দিচ্ছে আমরাও সেইভাবেই বিক্রি করছি।
বাংলাদেশ অটো রাইস ও মেজর হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি, রশিদ এগ্রো ফুড এর মালিক ও বাংলাদেশে মিনিকেটের আবিষ্কারক আব্দুর রশিদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত যেসব জাতের ধানগুলি চিকন বা মাঝারি চিকন বা লম্বা সাইজের বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন হচ্ছে সেগুলি থেকেই এখন মিনিকেট চাল উৎপাদন করছে মিলাররা। তবে এসব চালের কোয়ালিটির বিষয়ে তেমন কোন দেখভাল না থাকায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল বাজারজাত হচ্ছে। বাজারে এখন ৯০ ভাগ চাল ক্রেতাদের পছন্দ ও চাহিদার শীর্ষে মিনিকেট, কাজললতা এবং ২৮ নামের চিকন বা সরু চাল। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, তাই সবাই ভালো খেতে চায়। সে কারণে মিলাররাও ক্রেতার চাহিদা ধরে চাল উৎপাদন করছেন। যেহেতু দেশে মোটা চালের উৎপাদন বেশি সে কারণে মোটা চালের দাম কম এবং চিকন ধানের উৎপাদন কম সে কারণে চিকন চালের দাম একটু বেশিই হবে বলে জানালেন তিনি। অন্যদের উৎপাদিত মিনিকেট চালের ব্যাগে বিভিন্ন জাতের মিশ্রণ চাল আছে স্বীকার করলেও তার নিজের মিলে উৎপাদিত মিনিকেট চালের ব্যাগে মোটা-চিকনের মিশ্রণ নেই বলে দাবি করেন আব্দুর রশিদ। যদিও চালের বাজারে তথ্যানুসন্ধানকালে স্বাক্ষ্য প্রমাণসহ রশিদ মিনিকেট চালের ব্যাগ থেকেও বিভিন্ন জাতের মিশ্রিত চালের নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলিও মোটা চালের শ্রেণিভুক্ত বলে নিশ্চিত করেছেন ধান গবেষণা ইন্সস্টিটিউট এবং বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসি।
মিলাররা মিনিকেট চাল উৎপাদনে ঝুঁকে পড়ার লাভজনক আরও কারণ রয়েছে। সেগুলি হলো- চালের আকার পরিবর্তন বা ঘষামাজা করে চালের ক্ষয়জনিত কারণে মিলারদের প্রকৃত অর্থে সিস্টেম লস হয় না বরং বাই-প্রডাক্ট সিস্টেমে অধিক মুনাফার খাতও সৃষ্টি হয়েছে। কাটছাট বা ঘষামাজা বা পলিশ যে নামেই বলা হোক এর মাধ্যমে যে বাই-প্রডাক্ট হচ্ছে সেগুলি মিনিকেট চালের থেকে দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে বিক্রি হয়। যেমন হ্যাচারি/নার্সারি ফিড, রাইস ব্র্যানওয়েল যা উচ্চমূল্যের বাই-প্রডাক্ট। খুদ-কুড়া পশুখাদ্য হিসেবে তার বাজার মূল্য রয়েছে। এছাড়া হাস্কিং মিলের ধান থেকে ছাড়ানো খোসা বা তুষ যা এক সময় জ্বালানি হতো সেগুলি অটো রাইস প্লান্টে ক্রাসিং হয়ে পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে যার বাজার মূল্য রয়েছে। অর্থাৎ ধানের কোন অংশই এখন ফেলনা নয়। মিলারদের দেয়া তথ্যমতে, প্রতিমন ধান থেকে ফ্রেস মিনিকেট চাল পাচ্ছেন ২৬ কেজি মানে প্রতি দশমন ধান থেকে ফ্রেস মিনিকেট চাল হচ্ছে সাড়ে ছয় মণ। উচ্চমূল্যের হ্যাচারি/নার্সারি ফিড হচ্ছে ১৫ কেজি, রাইসব্র্যান হচ্ছে ৫ থেকে ৬ কেজি। এসবের বাইরে পশু খাদ্য কালোচাল/খুদ ৭ থেকে ১০ কেজি, কুড়া হয় ৭০ থেকে ৮০ কেজি এর সবগুলিরই বাজার মূল্য রয়েছে। প্রতি কেজি হ্যাচারি ফিড আশি থেকে পঁচাশি টাকা। প্রতি কেজি খুদের মিলরেট ২৫ টাকা, কুড়ার মিলরেট প্রতি কেজি ১২ টাকা। রাইসব্র্যান প্রতিকেজি ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ টাকা। এখন যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করলেই পরিষ্কার হবে আকার পরিবর্তন, কাট ছাট বা ঘষামাজা যেটাই হোক না কেন তাতে চালের মূল্য বাড়ে না কমে?
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড টেকনলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম তালুকদার বাজার থেকে অধিক জনপ্রিয় আটটি ব্র্যান্ডের মিনিকেট নামীয় চিকন/সরু চালের সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষাপূর্বক প্রাপ্ত ফলাফল ব্যাখ্যা করে বলেন, এ চালগুলি সবই মোটা চাল। বিভিন্ন ধরনের মেশিনে ব্লেন্ডিং করে কেটে-ছেঁটে পলিশ করা হয়েছে। ফলে চালের উপরিস্থ স্তর ফেলে দেয়া হয়েছে, থাকছে শুধু কার্বহাইড্রেট। স্বাভাবিক চাল থেকে যে ফ্যাট ও ভিটামিন বি-২ সহ যেসব খাদ্য ক্যালরি পাওয়ার কথা তার কিছুই বিদ্যমান নেই এসব পরিক্ষিত নমুনা চালের মধ্যে। ফলে ভোক্তারা টাকা দিয়ে যে সব চিকন/সরু চাল কিনে খাচ্ছেন তাতে প্রতারণার শিকারই হচ্ছেন।
ইবি’র খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগে চিকন/সরু চালের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রফেসর ড. হারুন-উর-রশিদ আসকারী বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বর্তমান সরকার গত ১০ বছরে যে অর্থব্যয় করেছে তা এখনও সাফল্যের শীর্ষে। আমরা এখন দাবি করতে পারি যে বাংলাদেশ কেবল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয় উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশ। কিন্তু সরকারের এই যে সফলতা বা অর্জন তার সুফলভোগী হতে পারছেন না প্রান্তিক দেশবাসী। এটা হতে পারে না যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের নানা রকম সিন্ডিকেশনের কারণে সরকারের এই সাফল্য জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছতে বিঘ্ন ঘটাবে। সরকারের সুবিধা নিয়ে দেশের কৃষক স্বাবলম্বী হতে পারবে না অনৈতিক মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কারণে চাল উৎপাদনকারী কৃষককূল মেরুদণ্ডহীণ হয়ে পড়বে এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। আবার চাল ভোক্তারাও প্রতারিত হচ্ছেন এটা অনাকাঙ্ক্ষিত । এ বিষয়গুলি প্রয়োজনে অধিক গুরুত্বের সাথে গবেষণাপূর্বক প্রকৃত সমস্যগুলি চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবেন সরকার।
কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, বাজারে চাল কিনে গুণগত মানে ও দামে যদি ক্রেতাসাধারণ ঠকে থাকেন তাহলে সেটা দেখার দায়িত্বে রয়েছেন বাজার মনিটরিং কমিটি। তারাই বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় করণীয় ঠিক করবেন। চালের বাজারে বিদ্যমান এমন বাস্তবতার কথা স্বীকারও করেছেন বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা। কোথা থেকে বা কিভাবে মোটা চালকে চিকন করে বাজারে দেয়া হচ্ছে তারা বিষয়টি মনিটরিং করে উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবিও করেন।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন চাল ভেজালের সকল দিক অবহিত পূর্বক গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির বিশদ প্রতিবেদন তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা এবং গুণগত মান একটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছনো এসডিজির অন্যতম গোল। সরকারের দুইটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে সিআইপি-১ এবং সিআইপি-২ বাস্তবায়নে যে এসডিজির লক্ষগুলি অর্জিত হবে। আমাদের নিরাপত্তা ও দেশের স্বার্থে এটা অর্জন করতে হবে। খাদ্যের নিরাপত্তা এবং গুণগত মান, এই কার্যক্রমের সাথে যে সকল উপাদান অর্থাৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপনন পর্যন্ত যারা জড়িত আছেন, যে কোন মূল্যেই হোক উৎপাদনের ক্ষেত্রেও যেন একটি মান অর্জন করতে পারি এবং ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সকল স্টেকহোল্ডারদের দায়িত্বশীল হতে হবে।