দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ, কৃষি ও পরিবেশ রক্ষায় কয়েকশ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মার শাখা গড়াই নদী খনন করছে সরকার। যদিও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিপুল ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাক্সিক্ষত সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে। অবশ্য নদী তীরবর্তী জনপদের মানুষ খননের সুফল না পেলেও খননের মাধ্যমে তোলা বালু বেচে পকেট ভারী হচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালী কিছু মানুষের। সরকারের কোষাগারে কোনো রাজস্ব জমা না দিয়েই নদী খনন প্রকল্পের মাধ্যমে তোলা বালু কোটি কোটি টাকায় বেচছে নানা শ্রেণি-পেশার ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কয়েকটি চক্র।
আর এ বালু বেচার টাকার ভাগ জেলা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাসহ জেলার ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের পকেটেও যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে গত অর্থবছর বেচে প্রভাবশালীরা (২০২১-২২) প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব ড্রেজার চালিয়ে গড়াই নদীর নাব্য উদ্ধারে খননকাজ সম্পন্ন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রকল্পের কাজ চলাকালে গড়াই নদীর বাম ও ডান তীরবর্তী কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী ও খোকসা উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় খনন করা বালু স্তূপ করে রেখেছিল পাউবো। পরে উত্তোলন করা বালুর উত্তোলন ব্যয় এবং বিদ্যমান বাজারমূল্য সংক্রান্ত পাউবোর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগ বালুমহালগুলোর কাক্সিক্ষত রাজস্ব মূল্য নির্ধারণ করে ইজারা দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া-জয়নাবাদ-লাহিনী মৌজার বালুমহাল। যেটির কাক্সিক্ষত রাজস্ব মূল্য ধার্য করা হয় ৪ কোটি ৯৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। এ বালুমহালসহ আরও পাঁচটি বালুমহাল ইজারা খাত থেকে চলতি অর্থবছর (বাংলা ১৪২৯ সনে) ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৩ হাজার টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। অথচ গত অর্থবছরেও এ বালুমহালগুলো থেকে ইজারা বাবদ ওই পরিমাণ অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা পড়েছিল।
জেলার রাজস্ব বিভাগ বলছে, দরপত্রে কাক্সিক্ষত রাজস্ব প্রস্তাব না পাওয়ায় ওই পাঁচটি বালুমহালকে এবার ইজারা দেওয়া হয়নি।
যদিও স্থানীয় নানা শ্রেণি-পেশার ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কয়েকটি চক্রের সঙ্গে রাজস্ব বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বালুমহালগুলো ইজারা নিতে আগ্রহী দরদাতাদের দরপত্র জমাদানে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে এসব বালুমহাল ইজারা না হলেও সেগুলো থেকে এরই মধ্যে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি করেছে বালুখেকোরা। অভিযোগ আছে, এ বালু বিক্রির টাকার ভাগবাটোয়ারার হিস্যা নিতে পিছিয়ে নেই জেলা প্রশাসনের কিছু ব্যক্তিসহ জেলার ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা। যে অভিযোগের সত্যতা ফুটে উঠে পাউবোর কুষ্টিয়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্যে। তিনি জানান, ইজারা না নিয়েই অবৈধভাবে বালু বিক্রি রোধে একাধিক সাধারণ ডায়েরিসহ জেলা প্রশাসনে চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখনো পাননি প্রতিকার। অবশ্য অভিযোগের সত্যতা পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে ভাষ্য কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সিরাজুল ইসলামের।
কুষ্টিয়া জেলা রাজস্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বালুমহালের সংখ্যা ২৬টি। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে (বাংলা ১৪২৯ সনে) ১৩টি বালুমহালকে ইজারাযোগ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দরপত্র আহ্বান করে রাজস্ব বিভাগ। অবশিষ্ট বালুমহালের বিষয়ে কিছু সমস্যা থাকায় সেগুলো ইজারা প্রক্রিয়ার বাইরে রাখে সরকার। যেমন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর আশপাশ এলাকা সুরক্ষা এবং কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়ক নদীভাঙনের ঝুঁকিতে থাকায় এর আশপাশের বাহিরচর, পূর্বদাদাপুর, চরগোলাপনগর ও আরাজিসাড়াসহ আটটি বালুমহাল ইজারামুক্ত রাখতে কোনো দরপত্র আহ্বান করেনি সরকার।
পরিবর্তনের অঙ্গীকারের অনুসন্ধানে জানা যায়, দরপত্রে কাক্সিক্ষত রাজস্ব প্রস্তাব না পাওয়ার অজুহাতে ইজারা না দেওয়া পাঁচটি বালুমহালের মধ্যে একটি জয়নাবাদ, লাহিনীপাড়া ও ছেঁউড়িয়া মৌজার বালুমহাল। যেটি গত অর্থবছর সদর উপজেলার যুগিয়া গ্রামের মাহবুব আলমের স্বত্বাধীন মুক্তা এন্টারপ্রাইজকে ইজারা দিয়ে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছিল ৪ কোটি ৫০ লাখ ১০ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছর এ বালুমহালটির জন্য রাজস্ব বিভাগের কাক্সিক্ষত রাজস্ব মূল্য ধরা হয়েছিল ৪ কোটি ৯৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। কাক্সিক্ষত রাজস্ব প্রস্তাব না পাওয়ার অজুহাতে ইজারা না দেওয়া আরেকটি বালুমহালের অবস্থান ভাড়রা মৌজায়। পাশাপাশি থাকা এ দুটি বালুমহাল থেকে অবৈধভাবে টোল আদায়কারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জায়গা দুটি থেকে প্রতিদিন অন্তত ৩০০ ড্রাম ট্রাকে (প্রতিটি থেকে ১৭০০ টাকা টোল আদায়) এবং ১০০ ট্রলিতে (প্রতিটি থেকে ২৫০ টাকা টোল আদায়) বালু পরিবহন করা হয়। বালুমহাল দুটি থেকে দৈনিক আদায় করা টোলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে গত ছয় মাসে শুধু এ দুটি বালুমহাল থেকেই অবৈধভাবে প্রায় ১০ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি করেছে বালুখেকোরা। একইভাবে বহলাগোবিন্দপুর ও চাপড়া, ঘোড়ামারা ও রানাখড়িয়া এবং মিরপুরের মিনাপাড়া, কাকদহ, কিত্তিনগর ও বিশালচণ্ডি মৌজার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অন্য তিনটি বালুমহাল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করে সরকারি রাজস্বের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি বালুখেকো চক্রের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, এ তিনটি বালুমহাল থেকে গত ছয় মাসে অন্তত ৩০ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে জেলার আটটি বালুমহাল ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা হলো মো. মহিদুল ইসলাম, মো. মাসুদ রানা, এসএম এন্টারপ্রাইজ (স্বত্বাধিকারী এসএম রাশেদ), মারুফ মোর্শেদ, মো. মিরাজ বিশ্বাস, মো. আনছার আলী, মেসার্স মাইক্রো ডাইনামিক (স্বত্বাধিকারী পারভেজ আনোয়ার ওরফে তনু) এবং মো. রঞ্জু আহমেদ। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আটটি বালুমহাল ইজারা দিয়ে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৬ হাজার টাকা।
অভিযোগ আছে, এসএম এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স মাইক্রো ডাইনামিক চলতি অর্থবছরে যথাক্রমে উত্তর মূলগ্রাম, হিজলাকর, এনায়েতপুর ও গোবিন্দপুর মৌজা এবং তেবাড়িয়া-শেরকান্দি মৌজার বালুমহাল ইজারা নিয়ে সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অথচ এ দুটি প্রতিষ্ঠানই ইজারাযোগ্য পাঁচটি বালুমহাল ইজারা না নিয়েই সেখানকার বালু উত্তোলন ও বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করলেও সরকারের কাক্সিক্ষত ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৩ হাজার টাকার রাজস্ব আত্মসাৎ করেছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মেসার্স মাইক্রো ডাইনামিকের স্বত্বাধিকারী পারভেজ আনোয়ার পরিবর্তনের অঙ্গীকার কে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ যিনিই করুন তা অসত্য ও বানোয়াট এবং মনগড়া অভিযোগ। ’
রাজস্ব না দিয়ে অবৈধভাবে বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলনের প্রতিকার চেয়ে থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করাসহ জেলা প্রশাসনকে চিঠি পাঠিয়েছেন বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কুষ্টিয়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান পরিবর্তনের অঙ্গীকার কে জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত মেলেনি কোনো প্রতিকার। বালুখেকোদের প্রতিরোধে অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে প্রায় একই ধরনের তথ্য তুলে ধরেন কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিরুল ইসলাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বালু উত্তোলন ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন না মেনে ব্রিজ-কালভার্ট, সেতুসহ সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপদ বেষ্টনী লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলনের প্রতিকার এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসনে চিঠি পাঠিয়েছি। তবে কোনোভাবেই অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন বন্ধ করা যায়নি। ’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘জেলার যেসব বালুমহাল কাক্সিক্ষত রাজস্ব না আসায় ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি সেগুলো থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রির অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ইতিমধ্যে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের একাধিক অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করেছি। তবে সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে ইজারাবহির্ভূত জয়নাবাদ, লাহিনীপাড়া, ছেঁউড়িয়া ও ভাড়রা মৌজার বালুমহাল থেকে স্টাককৃত (সরকারি টাকায় নদী খননের মাধ্যমে উত্তোলন করা বালু) বালু অবৈধভাবে উত্তোলন করে কেউ বিক্রি করেছে এমন তথ্য আমার জানা নেই। এমন অভিযোগের সত্যতা পেলে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এইচএ/কেএসসি