অঙ্গীকার ডেস্ক : বাংলাই প্রবাদ আছে ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ ঋতু রাজ বসন্ত।বাংলার আবহমান বৈচিত্র্যময় মাঘ কে বিদায় জানিয়ে ফাল্গুনের ঋতু রাজ বসন্তের আগমন ।
বসন্তের বাণী নতুনকে বরণ করার, পুরাতনকে বর্জন করার। ফাল্গুন ও চৈত্র এ দুটি মাস অতি মধুর রুপে সেই বাণীকে বসন্তের বীণায় ঝংকৃত করে তোলে। শীতের রিক্ততাকে সিক্ত করে দিয়ে নবীন সূর্যের আলোয় স্নাত হয়ে তাই আগমন ঘটে বসন্তের। যে যেভাবেই বলুক, বসন্ত বয়ে আনে নতুনের বার্তা। পুরোনো, জরা, প্রাণহীনতাকে পরিত্যাগ করার ঘোষণা থাকে বসন্তের বাতাসে। গাছের পুরোনো পাতা ঝরে পড়ে। বনের ভেতর থেকে হঠাৎ হঠাৎ ডেকে ওঠে কোকিল। উতলা মন প্রাণের মানুষকে খোঁজে। শীতের জড়তা কাটিয়ে, ফাগুনের দখিনা সমীরণে যেন সকলের ঘুম ভাঙে। সত্যি কথা বলতে কি ৫০ বছর আগের মতো বনে বনে ফাগুনে আজ আর কোকিল ডাকে না। পলাশ, শিমুল ও মান্দার বৃক্ষও বিলুপ্ত হওয়ার পথে। সেসব গাছের ডালে থোকা থোকা রক্ত লাল ফুলেসৌন্দর্য এখন আর চোখে পড়ে না। আমগাছও যেন কমে গেছে। আমের মুকুলের সোঁদা গন্ধে চারদিক ম-ম করে না। কবি গুরু যখন জাতীয় সংগীতে ‘আমার সোনার বাংলা’ লিখেছিলেন, তখন সত্যিকার অর্থে ফাগুনে আমের বনের ঘ্রাণে পাগল করত। জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে কিন্তু এ জন্য ফাগুনের আগুন নিভে যায় নি। এ মাস আছে থাকেবে। আর ভালোবাসার মাস হিসেবে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেবে। বৈশাখ থেকে ফাগুন শুধুমাত্র ঋতু বৈচিত্রই দেখা যায় না, এদেশের উৎসবপ্রবণ মানুষের মাঝে বরং সংস্কৃতির নব বাতায়নও খুলে দেয়। যান্ত্রিক এই শহরের নাগরিকরা রূপের ঋতু ফাগুনকে নিয়ে অন্তহীন প্রেমের পংক্তি রচনা করে। ফাগুন আজ বাঙালির নব জাগরণের, প্রণোদনার সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। ফাগুনে প্রকৃতির যেমন হলুদের ছোঁয়া ক্রমশই বৃদ্ধি পায় তার সাথে তাল মিলিয়ে নাগরিক জীবনেরও যেন রং বদলায়। এদিন বাঙালিরা উৎসবে মেতে ওঠে, হলুদ আর লালে রঙিন হয়ে জানিয়ে দেয় ভালবাসার কথা। দেশের প্রতি, দেশের সংস্কৃতির প্রতি দেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের প্রতি অকুণ্ঠ ভারোবাসার প্রকাশ থাকে এ রঙে। বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে… বন্ধুর বাড়ির ফুল বাগানে, নানান বনের ফুল/ ফুলের গন্ধে মন আনন্দে, ভ্রমরা আকুল… শীতের রিক্ততা মুছে প্রকৃতিজুড়ে আজ যেন কিসের শিহরিত স্পর্শ; সোঁদা মাটি আর বহেড়া ফুলের গন্ধ মেশানো অবাক ছোঁয়া! মন টেনে নিয়ে যায় শিমুল-পলাশ-আশোকের রক্তরাগে-তার ঝরা ফুলের গন্ধে…। আজ পয়লা ফাল্গুন। বিপুল ঐশ্বর্যধারী ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। পাগল হাওয়ার উত্তরীয় উড়িয়ে বনফুলের পলস্নবে , দখিন-বাতাসে শিহরণ জাগানোর দিন। উড়াল মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে উঠবার আভাস আর বনতলে কোকিলের কুহুতানে জানান দিয়ে যায়- আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আবহমান বাংলার নৈসর্গিক প্রকৃতিতে আজ সাজ সাজ রব। হিমেল পরশে বিবর্ণ ধরায় জেগে নবীন জীবনের প্রাণের লস্নাস। নীল আকাশে সোনা ঝরা আলোকের মতোই আজ হৃদয় আপস্নুত প্রাণভরা ভালোবাসায় । ফাগুন হওয়ায় বয়ে যাবে সুর- ‘ প্রিয় ভালোবাসি … ভালোবাসি, শুধু ভালোবাসি তোমায়’। আজ শুধুই ভালোবাসার দিন। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
পর্বতসম ব্যস্ততা উপেক্ষা করে ভালোবাসার পাল তোলা নায়ে আজ ভাসবে সবাই। সারাবিশ্বের মতো তারুণ্যের অনাবিল আনন্দ আর বিশুদ্ধ উচ্ছ্বাসে প্রেমের মাতাল হাওয়া বয়ে যাবে দেশময় । ভালোবাসার উৎসবে মুখর হবে ধনী – গরীব, যুবা-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী সবাই। রবি ঠাকুরের গানে সুর তুলে আজ লাখো কোটি হৃদয় উঠবে গেয়ে- ভালোবাসি, ভালোবাসি/ এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি/ আকাশে কার বুকের মাঝে-ব্যথা বাজে/ দিগন্তে কার কালো আঁখি-আঁখির জলে যায় ভাসি… ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন – হাসি/ ভালোবাসি, ভালোবাসি।
ভালোবাসার আবেগে আপস্নুত হয়ে প্রেমিক হৃদয় উঠবে গেয়ে- ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে/ আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে/ আমার পরানে যে গান বাজিছে / তাহার তালটি শিখো তোমার চরণমঞ্জীরে… আমার আকুল জীবন মরণ / টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো তোমার অতুল গৌরবে।
বিশ্ব ভালোবাসার উৎসবের ছোঁয়া শহরের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়বে সারা গ্রাম – বাংলায় । মুঠোফোনের খুদেবার্তা, অনলাইনের ই-মেইল আর ফেসবুক চ্যাটিংয়ে প্রেমকথার কিশলয়। তীব্র সৌরভ ছড়িয়ে ফুটবে ফুল সৌন্দর্যবিভায় । প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে তালে তাল রেখে ভালোবাসার জয়গানে সুর মেলাবে স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা, ভাইবোন সবাই। বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, এমনকি সহকর্মীর মাঝেও দিনভর হবে ভালোবাসার ভাব বিনিময় ।
ভালোবাসা দিবস উদযাপনের ইতিহাস বেশ পুরানো। এ নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে । তবে সবচেয়ে বেশি যে গল্পটি প্রচলিত সেটি হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজকের ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের একটি ঘটনা নিয়ে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে ওই ধর্মযাজক একইসঙ্গে চিকিৎসক ছিলেন। তখন রোমান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস । বিশ্বজয়ী রোমানরা একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে চলেছে। যুদ্ধের জন্য রাষ্ট্রে বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু লোকজন বিশেষ করে তরুণরা এতে উৎসাহী নয়। সম্রাটের ধারণা হলো, পুরুষরা বিয়ে করতে না পারলে যুদ্ধে যেতে রাজি হবে। তিনি তরুণদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু প্রেমপিয়াসী তারুণ্যকে কী নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায়! এগিয়ে এলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। ভ্যালেন্টাইন প্রেমাসক্ত তরুণ-তরুণীদের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু একদিন ধরা পড়ে গেলেন ভ্যালেন্টাইন। তাকে জেলে পোরা হলো। দেশজুড়ে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। অনেকেই ভ্যালেন্টাইনকে জেলখানায় দেখতে যান। ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে আসেন। কারাগারের জেলারের একজন অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। চিকিৎসক ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির অন্ধত্ব দূর করলেন। তাদের মধ্যেও সৃষ্টি হলো হৃদয়ের বন্ধন। ধর্মযাজক হয়েও নিয়ম ভেঙে তিনি প্রেম করেন। আইন ভেঙে তিনিও বিয়ে করেন। খবর যায় সম্রাটের কানে। তিনি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড দেন। সে তারিখটি ছিল ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই ১৪ ফেব্রম্নয়ারি। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে তার প্রিয় বধূকে যে চিঠিটি লিখেন তা শেষ হয়েছিল এভাবে- লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন। অতঃপর এই ভালোবাসার স্বীকৃতি পেতে দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে পালন করতে হয়েছে ১৪ ফেব্রম্নয়ারি। ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমের রাজা পপ জেলুসিয়াস এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ার পেছনে আরও একটি কারণ রয়েছে । সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মৃতু্যর আগে প্রতি বছর রোমানরা ১৪ ফেব্রম্নয়ারি পালন করত ‘জুনো’ উৎসব। রোমান পুরাণের বিয়ে ও সন্তানের দেবী জুনোর নামানুসারে এর নামকরণ। এ দিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তার নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত। ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হয় তখন ‘জুনো’ উৎসব আর সেন্ট ভ্যালেনটাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেঁথে ১৪ ফেব্রম্নয়ারি ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’ হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপ এবং ইউরোপ থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ।
Post Views: 224