খুলনা বিভাগে করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। শনাক্ত ও মৃত্যুতে প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে। গতকাল একদিনেই বিভাগটিতে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ছয়দিনে মৃত্যু হয়েছে দুই শতাধিক কভিড রোগীর। নতুন করে ১ হাজার ৪৭০ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্তবর্তী হওয়ায় বিভাগটিতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকটও। এ দুইয়ে মিলে বিভাগটিতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
দেশে এখন করোনার ভারতীয় ধরন বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সীমান্তবর্তী হওয়ায় খুলনা বিভাগে প্রথম থেকেই এ ধরন মারাত্মকভাবে সংক্রমিত করতে থাকে। যে কারণে বিভাগটিতে এখন করোনা রোগীর শনাক্ত ও মৃত্যুতে প্রতিদিনের রেকর্ড ভাঙছে। পাশাপাশি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বিভাগের চিকিৎসক সংকটসহ অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থাও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগে উপজেলা পর্যায়ে ১ হাজার ৩২৭টি চিকিৎসকের পদ রয়েছে। তবে এর বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৪৩১ জন। সে হিসাবে ৬৭ দশমিক ৫ ভাগ চিকিৎসকের পদই পূরণ করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় চাইলেও যথাযথ সেবা দিতে পারছে না হাসপাতালগুলো।
সারা দেশের মতো এ বিভাগেও জটিল করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহূত অন্যতম প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও আইসিইউ শয্যার সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, খুলনা বিভাগে আইসিইউ শয্যার সংখ্যা মাত্র ২৬টি। এছাড়া সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা আরেকটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করেছেন সেটি হলো নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীরা অবস্থার অবনতি হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। তখন নানা সংকটের মুখে পড়েন চিকিৎসকরা। একারণে বেড়ে যায় রোগী মৃত্যুর হার। সব মিলিয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী এ বিভাগের ১০ জেলায় করোনা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে।
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছে ৬২ হাজার ৩৪ জন কভিড পজিটিভ রোগী। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ২৬৫ জন। এ সময় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৪০ হাজার ৫৫৩ জন।
কভিড ইউনিটে চিকিৎসায় জড়িত এক চিকিৎসক জানান, উপসর্গ বিবেচনায় যাদের করোনা রয়েছে বলে মনে হয়েছে বা যারা হাসপাতালে ভর্তিযোগ্য তাদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে এখানকার করোনা শনাক্তের হার বেশি। আবার এখানে যে ভাইরাস রয়েছে সেটি বেশি সক্রিয় ও ক্ষতিকর। সেজন্য এ বিভাগে শনাক্তের হার ও সংক্রমণ বেশি।
যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বণিক বার্তাকে বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ বাড়ছে খুব দ্রুত। এতদিন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের যতগুলো ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে সংক্রামক ও দ্রুত বিস্তারে সক্ষম। তবে খুলনায় মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে কেবল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারই দায়ী নয় কভিড-১৯ চিকিৎসায় যথাযথ অক্সিজেন থেরাপি ও আইসিইউর সংকটও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। এ কারণেই এখন উচিত ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোয় কভিডের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা দুই-তিন গুণ বাড়ানো। সেটি করা না হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যাবে না।
এদিকে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে খুলনা জেলার একটি বেসরকারিসহ চারটি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের। ধারণক্ষমতার অনেক বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে হাসপাতালগুলোতে। পাশাপাশি নেই পর্যাপ্ত জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম এর মধ্যেই চালিয়ে নিতে হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ হাসপাতালগুলোতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কভিড-১৯ রোগে ১২ জনের ও উপসর্গ নিয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়।
খুলনা ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের মুখপাত্র চিকিৎসক সুহাস রঞ্জন হালদার বণিক বার্তাকে বলেন, আইইডিসিআরের গবেষণার তথ্য আমলে নিলে এ বিভাগে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ার পেছনে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে অধিকাংশ রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে দেরিতে। অক্সিজেন লেভেল কম থাকা রোগীর সংখ্যা বেশি আসছে। যারা ভর্তি হচ্ছে তারা আগে থেকেই করোনায় আক্রান্ত ছিল, বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিল। অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার পর তারা হাসপাতালে আসছে।
ডা. সুহাস বলেন, ১৩০ শয্যার ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে ৭৭টি শয্যায় রয়েছে কেন্দ্রীয় অক্সিজেনের ব্যবস্থা বাকি রোগীদের ভরসা সিলিন্ডারের অক্সিজেনের ওপর। তবে অতিরিক্ত রোগীর চাপ থাকলেও বর্তমানে অক্সিজেনের সংকট নেই। হাসপাতালটিতে ৫৩টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা সদর হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি আছে ৬৩ জন এ হাসপাতালের মুখপাত্র কাজী আবু রাশেদ বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ জন নতুন করোনা রোগী ভর্তি হয়েছে। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১২ জন।
খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের মুখপাত্র চিকিৎসক প্রকাশচন্দ্র দেবনাথ জানান, তাদের হাসপাতালের ১০টি আইসিইউসহ ৪৫ শয্যার করোন ইউনিটে বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ৪১ জন। এর মধ্যে আইসিইউতে আছে ১০ জন। শনিবার থেকে সেখানে রোগী ভর্তি শুরু হলেও গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে একজন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
বেসরকারি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী মিজানুর রহমান জানান, তাদের হাসপাতালে বর্তমানে ঢাকা থেকে বড় বড় অক্সিজেন সিলিন্ডার আনা হচ্ছে। এখন নয়টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে তাদের।
খুলনা বিভাগের করোনায় বিপর্যস্ত আরেকটি জেলা যশোর। এ জেলায়ও করোনায় মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে কঠোর লকডাউনের ১২ দিনে করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১৪১ জন। আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ৩৯২ জন। যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলানো যাচ্ছে না। ১১০টি শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৫০। মাত্র একজন চিকিৎসক রোটেশন অনুযায়ী করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১১টি। গত ২৪ ঘণ্টায় যশোর জেনারেল হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে ও এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১৬ জন।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. আরিফ আহমেদ বলেন, তাদের হাসপাতালের রেড জোনে মোট ভর্তি রয়েছে ১২৬ জন। আর ইয়েলো জোনে আছে ৮৬ জন।
এদিকে সোমবার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে করোনা পরীক্ষায় ৪৪৫ জনের মধ্যে ১৮৬ জনের নমুনায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের এ হার ৪১ দশমিক ৭৯।
যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আক্তারুজ্জামান জানান, হাসপাতালে মঞ্জুরীকৃত ৫৫ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত আছেন ৪৩ জন। ১২টি পদ শূন্য রয়েছে। একজন চিকিৎসক ৮ ঘণ্টা পরপর করোনা রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সংকট মোকাবেলায় ২০ জন চিকিৎসক চেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান জানান, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে প্রশাসনের তত্পরতা অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মাঠে সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরাও রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সরকার নতুন করে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিয়েছে করোনাকালে নিজেদের সম্পদেরই সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, একটি দেশে প্রতি একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এ অনুপাত ১:০.৫৬। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে অনুমোদিত জনবলের ২৫ ভাগ কম জনবল নিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অপ্রতুল জনবল দিয়েই করোনা মহামারী মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সে কারণে বিভিন্ন ধরনের সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে।
এর আগে মহামারী মোকাবেলায় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে দেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপনের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেজন্য জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপনের অবকাঠামো আছে কিনা তা যাচাই করে গণপূর্ত অধিদপ্তর সে সময় জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের অবকাঠামো নেই। বেশির ভাগ জেলা হাসপাতাল ভবনগুলো পুরনো হওয়ায় সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন বসানো যাবে না। সংক্রমণ প্রতিরোধী যে ব্যবস্থা নিতে হয়, কাঠামোগত কারণে তা-ও নেয়া যাবে না। সে কারণে এখন চাইলেও সব হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে কথা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মাদ খুরশীদ আলমের সঙ্গে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, জেলা হাসপাতালগুলোতে জনবল বাড়ানো হচ্ছে গত কয়েকদিনে বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়া ওষুধসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও বাড়ানো হয়েছে। আইসিইউ শয্যাও যথাসম্ভব বাড়ানো হচ্ছে। তবে অল্প সময়ে আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে আইসিইউ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত দক্ষ জনবল। চাইলেই দক্ষ জনবল গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এজন্য সময় প্রয়োজন। তার পরও সংকট মোকাবেলায় সব রকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার যশোর ও খুলনা প্রতিনিধি
উপদেষ্টা মন্ডলীর সভাপতি: মো: হাসান আলী
প্রধান উপদেষ্টা: মোঃ ওবাইদুর রহমান
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: খালিদ সাইফুল
নির্বাহী সম্পাদক: রাশিদুল ইসলাম
নির্বাহী সম্পাদক: মিজানুর রহমান
বার্তা সম্পাদক: আব্দুল কাদের
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: লাল মোহাম্মদ সড়ক, হাটশ হরিপুর নদীরকুল, কুষ্টিয়া-৭০০০।
মোবাইল : ০১৮১৫-৭১৭০৩৪ । ইমেইল : khalidsyful@gmail.com ।
ই-পেপার কপি