একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল অনেকটাই ‘একলা চলো’ নীতিতে চলছে। জোটের কার্যক্রম এখন দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ। শরিক দলগুলো বলছে, জোটের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে। করোনা মহামারির মতো বড় দুর্যোগে সমন্বিত কোনো ত্রাণ কার্যক্রমও নেওয়া যায়নি। যদিও অতীতে বন্যা-দুর্যোগে, বিরোধীদের সহিংসতা, সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ নানা ঘটনায় এ জোট সমন্বিতভাবে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করেছে।
১৪ দল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য, এর অর্জন কী, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে আওয়ামী লীগসহ সাতটি শরিক দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলছেন, ১৪ দলের শরিকদের ভেতর এখন আর উচ্ছ্বাস নেই। সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই ‘নিষ্ক্রিয়’ বলা যায়।
এর কারণ হিসেবে জোটের শরিকদের ব্যাখ্যায় মূল দুটি বিষয় উঠে এসেছে। ১. একটা জোট তখনই কার্যকর থাকে, যখন এর মধ্যে রাজনৈতিক সন্তুষ্টি থাকে। ২. শরিকেরা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলে জোটের শক্তি বাড়ে। বর্তমানে এর কোনোটিই নেই।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে জোটের শরিকদের কিছুটা অসন্তুষ্টি থাকতে পারে। কারণ, আমরা নিজেরাই নিজেদের ছাড় দিতে চাই না। এ জন্য শরিকদের অনেক চাওয়া পূরণ হয় না।
আমির হোসেন আমু, সমন্বয়ক, ১৪ দল
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে শরিকদের কাউকে রাখা হয়নি। এর আগের মেয়াদে (২০১৪ থেকে ২০১৮) ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তার আগের সরকারে (২০০৯ থেকে ২০১৪) অনেকটা আকস্মিকভাবে মন্ত্রিসভায় স্থান পান জোটের শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। কিন্তু ২০১৮ সালের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া জোটে অন্য শরিকেরা কেউ সরকারে স্থান পায়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর এক বৈঠকে শরিকদের ‘নিজের পায়ে’ দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন ১৪ দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের মধ্যে অনেকটা ‘একলা চলো’ নীতির পথে হাঁটা শুরু হয়।
তবে আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে তাদের নিজেদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড অনেকটা স্থবির হয়ে আছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের পর আওয়ামী লীগ চেয়েছে সংসদে সরকারি দল যেমনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের হবে, তেমনি বিরোধী দলও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের হবে। ফলে আদর্শিকভাবে ১৪ দল আওয়ামী লীগের সঙ্গী। আবার সরকার ও সংসদের বিবেচনায় তারা বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য যে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি থাকা দরকার, তা শরিকদের নেই।
১৪ দলের সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে ১৪ দল ঐক্যবদ্ধ আছে। মন্ত্রী–সাংসদ হবেন, বাদ যাবেন, আবার হবেন। এটা কোনো সমস্যা নয়। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে জোটের শরিকদের কিছুটা অসন্তুষ্টি থাকতে পারে। কারণ, আমরা নিজেরাই নিজেদের ছাড় দিতে চাই না। এ জন্য শরিকদের অনেক চাওয়া পূরণ হয় না।’ আমু বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ১৪ দল আগের মতো সক্রিয় হবে। তখন কার কী সমস্যা, তা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।
আওয়ামী লীগ নিজেই রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সামরিক-বেসামরিক আমলা ও অতিধনী ছোট একটা গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার।
রাশেদ খান মেনন, সভাপতি, ওয়ার্কার্স পার্টি
অন্যদিকে জোটের নেতারা বলছেন, সব দল যুগপৎভাবে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে বিরোধীদের মোকাবিলা করবে, এটাই ছিল ১৪ দল গঠনের লক্ষ্য। কিন্তু দুই দফায় তিনজন শরিক দলের নেতাকে মন্ত্রী এবং কয়েকজন সাংসদ নির্বাচিত করা ছাড়া প্রকৃত অর্থে দলগুলোর সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পায়নি। সারা দেশে তৃণমূলে ১৪ দলের অস্তিত্ব নেই। এক যুগের বেশি সময়ে জোটের নিজস্ব কোনো কেন্দ্রীয় দপ্তর গড়ে ওঠেনি। এ সময় জাতীয় পার্টি সরকারের কাছে যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, ১৪ দলের অন্য শরিকেরা ততটা গুরুত্ব পায়নি।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ দলের কার্যক্রমে ধীরগতি আছে। তৃণমূলকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনাও সফল হয়নি। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়েও মতদ্বৈধতা আছে। তবে এরপরও যারা মনে করে ১৪ দলের আর দরকার নেই, তারা ভুল ভাবছে। কারণ, এখনো মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তি তৎপর আছে। তাদের বিরুদ্ধে ১৪ দলই প্রধান শক্তি।
২০০৪ সালে ১৪ দল গঠন হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন এবং গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় কারানোর লক্ষ্যে। তবে কোনো কোনো শরিক দলের নেতারা মনে করেন, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল করে ফেলেছে। শরিক দলগুলো স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অরাজনৈতিক রাখার পক্ষে ছিল। কিন্তু সেটাও দলীয় প্রতীকে হচ্ছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। প্রায়ই সরকারদলীয় লোকজনের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করা থেকে শুরু করে সহিংস আচরণের অভিযোগ আছে। ফলে রাজনৈতিক সন্তুষ্টির জায়গা কমে এসেছে।
শরিক একটি দলের শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি ফিরে আসুক, আওয়ামী লীগ তা চায় না। আবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে না। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নিয়েও সন্দেহ-অবিশ্বাস আছে। জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলে রেখে ব্যবহার করছে। এ পরিস্থিতিতে ১৪ দলের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে শরিকেরা অন্ধকারে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩–১৪ সাল পর্যন্ত ১৪ দল কার্যত সক্রিয় ছিল। এরপরই আস্তে আস্তে দিবসভিত্তিক কর্মসূচিনির্ভর হয়ে পড়েছে। রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিজেই রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সামরিক–বেসামরিক আমলা ও অতি ধনী ছোট একটা গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। এর ফলে লুটপাট–দুর্নীতি বেড়েছে।’ মেনন বলেন, কাঠামোগতভাবে হয়তো ১৪–দলীয় জোটে তাঁরা আছেন। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাঁরা নিজস্ব প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।