বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রথম ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহার করা হলো। এর আগে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ বলা হলেও এবার লকডাউনের সাথে কঠোর শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতায় প্রশ্ন উঠেছে কঠোর লকডাউন কেমন হবে? বাংলাদেশে সোমবার থেকে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন শুরু হচ্ছে। করোনা সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যল কমিটির ১৪ দিনের শাটডাউনের প্রস্তাবে এই ঘেষণা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সাত দিনের জন্য সিদ্ধান্ত হলেও তা আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মো, শহীদুল্লাহ বলেন, ‘‘সংক্রমণ ঠেকাতে হলে লকডাউন হতে হবে কারফিউর মতো।’’ গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি দিয়ে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। আর এবার করোনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে কঠোর বিধিনিষেধ এবং আঞ্চলিক লক ডাউন চলছে। বাংলাদেশে অতীতে লকডাউন এবং কড়াকড়ি নিয়ে বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। পোশাক কর্মীদের ছুটি দিয়ে আবার করেনার মধ্যেই ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। গণপরিবহন বন্ধ রেখে ব্যক্তিগত যানবাহন চলেছে। এখনো সারাদেশে কড়াকড়ি রয়েছে, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছুই খোলা রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানার ক্ষেত্রেও রয়েছে উদাসীনতা। ঢাকার চারপাশের সাত জেলায় লকডাউন দিয়ে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ যেকোনো উপায়ে ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন। আবার ঢাকায়ও মানুষ আসছেন। দূর পাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকলেও এই যাত্রা থামানো যাচ্ছে না। সোমবার থেকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণার পরও অনেকে ঢাকা ছাড়ছেন। একইভাবে ঢাকায়ও আসছেন সমানভাবে। এখনো লকডাউনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। তবে লকডাউন কার্যকর করতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী এবং বিজিবি মোতায়েন থাকবে বলে জানানো হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশনাও থাকছে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ার জন্য পুলিশের কাছ থেকে এবারও মুভমেন্ট পাস নিতে হবে। জরুরি সেবা ছাড়া দোকানপাট, সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত, শিল্প কারখানা, যানবাহন চলাচল সব কিছু বন্ধ থাকবে। আর্থিকসহ অন্যান্য সেবা দেয়ার প্রয়োজনে কিছু অফিস সীমিত আকারে খোলা থাকবে। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা লকডাউনের আওতায় পড়বেন না। তবে পোশাক কারখানা খোলা রাখার দাবি জানিয়েছেন পোশাক কারখানার মালিকরা। সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার জানান, ‘‘রবিবার কঠোর লকডাউন নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। তাতে সুনির্দিষ্টভাবে গাইড লাইন থাকবে। তবে কেউ যাতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে না পারেন তা নিশ্চিত করা হবে।’’ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘‘লকডাউন কার্যকর করতে হলে সাম্যতার প্রয়োজন হয়। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে কিন্তু ব্যক্তিগত যানবাহন চলবে এটা হয় না। পোশাক কারখানা খোলা থাকবে কিন্তু দোকানপাট বন্ধ থাকবে সেটাও হয় না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সব বন্ধ রাখতে হবে। করোনা ছাড়ানো বন্ধ করতে হলে সঠিকভাবে লকডাউন কার্যকর করতে হবে। এরজন্য অতীতে সঠিক কোনো পরিকল্পনা ছিলো না । ফলে সফল হয়নি। এবার যে কঠোর লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে তার জন্য পরিকল্পনা কী তা এখনো স্পষ্ট নয়।’’ একই ধরনের কথা বলেন বিএসএমইউ’র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘লকডাউনের আগে একটি প্রস্তুতি থাকতে হয়। লকডাউনের সময় পুরো দেশ কীভাবে চলবে। জরুরি সেবাসহ খাদ্য ও পণ্য সরবরাহ কীভাবে হবে তার গাইডলাইন থাকতে হয়। লকডাউন মানতে আইনের প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু এখানো সেই পরিকল্পনা স্পষ্ট নয়।’’ তিনি বলেন, ‘‘লকডাউনে গরিব মানুষ কী খাবে। তাদের ঘরে রাখা যায় কীভাবে তার সুনির্দিষ্ট পরিকলল্পনা দিতে হয়। তাদের যদি খাবার না থাকে, আয় না থাকে তাহলে তাদের ঘরে আটকে রাখা যাবে না। তাই তাদের যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর মানুষ যাতে ঘরে বসে খাদ্য ও জরুরি সেবা পেতে পারে তার সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে লকডাউন কার্যকর করা অসম্ভব।’’ এদিকে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন চার হাজার ৩৪৩ জন। শনাক্তের হার সাড়ে ২২ শতাংশ। একদিন আগে এই হার ছিলো ২১ দশমিক দুই শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৭৭ জন। জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশে এখন করোনার সংক্রমণ খুবই উচ্চ হারের। তাই সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর লকডাউন কার্যকর করার কোনো বিকল্প নাই। সূত্র-ডয়চে ভেলে