অঙ্গীকার ডেস্কঃকুষ্টিয়ায় চিকিৎসা সেবা সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হলেন আরও একজন প্রসুতি মা। প্রতিনিয়ত নির্মম এই মৃত্যু মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলেও দায় নিচ্ছেন না কেউ। তিগ্রস্ত সংুব্ধ পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসা সেবার মুখোশ পড়ে কেবলমাত্র মুনাফা আয়ের ল্েয পল্লী চিকিৎসক, কিনিক মালিক, আয়া-নার্স, ব্রাদার ও দালালসহ নানা ধরনের চক্র গড়ে উঠেছে এই সেবাখাতকে ঘিরে। পিছিয়ে নেই নামী দামী চিকিৎসকরাও। এসব নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় তিগ্রস্ত পরিবার ও সদ্যজাত শিশুগুলির জীবন বিপর্যস্ত হলেও মন টলে না এসব ঘাতকদের। চিকিৎসকের মুখোশধারী কিছু সংখ্যক এসব ঘাতকদের কারণেই মহান এই পেশায় নিযুক্ত অন্যান্য চিকিৎসকগনের প্রতিও সম্মানহীন বাক্যবান বর্ষিত হয়ে থাকে বলে জানালেন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের কয়েকজন শিাগুরু। এমনই অভিযোগ উঠেছে- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক দপ্তরে নিযুক্ত বর্তমানে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল কুষ্টিয়ায় গাইনী ও অবস বিভাগে ডেপুটেশনে কর্মরত চিকিৎসক ডা: নাজনীন আক্তার জাহানের বিরুদ্ধে।
আবিদ হাসান(৭দিন) জন্মের আগেই শিশুটির নাম রেখেছিলেন মা নাসরিন নাহার রিপা(৩০)। সদ্যজাত ফুট ফুটে শিশুটির ঠাঁই হয়েছে নানীর বুকে। গত ১৩জুন, ১০মাসের অর্জিত সাফল্যের পুরষ্কার জুটেছে নির্মম মৃত্যুর হাতছানিতে। শহরের শীর্ষ প্রাইভেট কিনিক সনো হাসপাতালে কর্তব্যরত শল্যচিকিৎকের অবহেলাজনিত ভুল চিকিৎসার নির্মম বলি হলেন হতভাগা মা নাসরিন রিপা। সদ্যজাত ভাগ্য বিড়ম্বিত শিশু আবিদ হাসানকে কোলে নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে এভাবেই বলছিলেন নানী ফরিদা বেগম।
মৃত: নাসরিন নাহার রিপা ঝিনাইদহের মহেষপুর পৌর এলাকা বৈঠাতলার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বিপ্লবের স্ত্রী। তিনি গর্ভধারণের পর থেকে শেষ পর্যন্ত ডা: নাজনীন আক্তার জাহানের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীণ ছিলেন বলে কামরুল ইসলাম দাবি করেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহানের পরামর্শ ক্রমে গত ২৬মে,৮জুন,৯জুন রোগীর আল্টাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীা করা হয়। ৯জুন সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া সনো হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ঐ দিনই রাত ১২টার সময় সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে প্রসূতি একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন।রাত দেড়টার দিকে রোগী কে অপারেশন থিয়েটার থেকে ওয়ার্ডে নেয়া হয়। এর আগে একজন নার্স এসে রোগীর মা ফরিদা বেগম কে ছোট একটি থল থলে জিনিস দেখিয়ে বলে সিজার ও টিউমার একসাথে অপারেশন করা হয়েছে। পরদিন রোগীকে ৫০৬ নম্বর কেবিনে নেয়া হয়। ঞ্জান ফিরলে রোগী তার মা বোন কে জানায়,”ডাক্তার খুব ভালো মানুষ, আমার কাছে মাফ চেয়েছে।”এ সময় ঘুমের প্রভাবে বেশি কথা বলতে পারে নি।১২ তারিখ জ্বর ও পেট ব্যথা থাকা অবস্থায় এক প্রকার জোর করেই সনো হসপিটাল থেকে রোগী কে রিলিজ করে দেয়া হয়। বাড়ী এসে জ্বর বাড়তে থাকলে ১৩ তারিখ দুপুরে রোগী কে সনো হসপিটালে নিয়ে গেলে ভর্তি নিয়ে কালপেণ চলতে থাকে। পরামর্শ দেয় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।প্রায় দেড় ঘন্টা পর হসপিটাল কর্তৃপ ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহানের সাথে যোগাযোগ শেষে প্রসূতিকে ভর্তি নেয়। এসময় অবস্থা খারাপ হতে হতে প্রসূতির দেহ নিথর হয়ে যায় । কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করলেও ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহানের দেখা মেলেনি।
মৃত প্রসূতির পিতা রেজাউল ইসলাম নিজ সন্তানের মৃত্যুর জন্য ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহানের অবহেলা ও ভূল অপারেশন কে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি টিউমার অপারেশন করা হয় তবে সেটা বায়োপসি না করে ফেলে দেওয়া হলো কেন । আর অপারেশনে ভূল হলে মাফ না চেয়ে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া উচিত ছিল। ডাক্তার জানতেন আমার মেয়ে মারা যাবে,তাই তিনি দূরে থেকেছেন। পর্দানশীল ডাক্তার জন্য আমার মেয়ে তাঁর কাছেই সিজার করার সিদ্ধান্ত নেয়। নির্মমতার কাছে আমরা এখন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
মৃত প্রসূতি নাসরিন রিপার গর্ভধারণ থেকে শুরু করে গত ৯জুন রাত সাড়ে ১১টায় অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সকল পরিা-নিরীাসহ প্রাসঙ্গিক স্বাস্থ্য পরীা সংক্রান্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে কুষ্টিয়া মেডিকেলের গাইনী ও অবস বিভাগের চিকিৎসকরা মত দেন- “রিপোর্ট অনুযায়ী রোগীর সবকিছুই ঠিক ঠাক ছিলো। কিন্তু কি কারণে মারা গেলেন সে বিষয়ে পরীা নিরীা ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না”।
সচেতন নাগরিক কমিটি সনাক কুষ্টিয়ার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম টুকু পরিবর্তনের অঙ্গীকারকে বলেন, ভুল চিকিৎসা চিকিৎসা অবহেলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনাটি প্রায়শ: ঘটে। কিন্তু বিষয়টির সত্যমিথ্যা যাচায় নির্ভর করে মেডিকেল টেকনোলজি ও ডাক্তারদের উপরেই। সেেেত্র দেখা যায় স্ব-গোত্রীয় পেশাজীবী সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা থাকলেও অধিকাংশ েেত্র সহকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগকে অস্বীকার করার প্রবনতা থাকে। যে কারণে এজাতীয় ঘটনায় তিগ্রস্ত পরিবারের করা অভিযোগ কোন ভাবেই ভিত্তি পায়না। বিচার পায় না সংুব্ধ পরিবারগুলি। সেকারনে একেবারে প্রান্তিক পর্যায় হতে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের সকল বৈধ অবৈধ প্রাইভেট কিনিক এবং পল্লী চিকিৎসক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী নামী দামী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রোগী হত্যার অভিযোগ উঠলেও কোন দিন কোন প্রতিকার বা বিচার পাননি তিগ্রস্তরা। অথচ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কেউই আইনের উর্দ্ধে নই। এেেত্র অবশ্যই জেলার সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগ বা সিভিল সার্জন দায় এড়াতে পারেন না।
২৫০শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা: তাপস কুমার সরকার সহ জেলার ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাগণ অভিন্ন সুরে বলেন, সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে শত সহস্র সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবায় শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছি আমরা। এখানে বাচ্চা প্রসবকালীন সময়ে কোন মা ও শিশু মৃত্যুর হার এখন শুন্য কোটায় দাঁড়িয়েছে। প্রসবকালীন জটিলতায় জেলায় যে দুই একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে সেগুলি প্রাইভেট কিনিকগুলিতে ঘটছে।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে ৬৩১২টি জীবিত শিশু জন্মদিতে গিয়ে প্রসবকালীন সময়ে ৭জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। গেলো বছর ১২ মাসে প্রসবকালীন সময়ে মা মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ২৫জন। এসব মৃত্যুর ঘটনার ৮০%ভাগই ছিলো প্রাইভেট কিনিকগুলিতে ভুল চিকিৎসা বা অবহেলা জনিত কারনে ঘটেছে বলে তিগ্রস্ত পরিবার গুলির অভিযোগ।
তবে একই কারনে প্রসুতি মায়ের মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও শতাধিক হবে বলে জেলার স্থানীয় গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রের দাবি। ইতোপূর্বে ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলায় এজাতীয় প্রসুতি মৃত্যুর ঘটনায় বিচার চেয়ে দায়ের হওয়া কয়েকটি মামলা বিচারাধীন থাকলেও লাগাম ধরা যাচ্ছে না চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের দৌড়াত্মের।
অভিযোগ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মনিযুক্ত ও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসাপাতালের গাইনী ও অবস বিভাগে ডেপুটেশনে দায়িত্বরত এবং প্রসুতি মা নাসরিন রিপার মত্যুর ঘটনাস্থল জেলার শীর্ষ প্রাইভেট কিনিক সনো হসপিটালের চিকিৎসক ডা: নাজনীন আক্তার জাহানের সাথে কয়েকদিন ধরে কথা বলতে যোগাযোগ করলে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। প্রাইভেট কিনিকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তিনি দেখা করেননি। এমনকি বিকল্প তার স্বামী একই কিনিকের প্রাকটিশনার শিশু চিকিৎসক ডা: হাসান সরোয়ার কল্লোলের সাথে যোগাযোগ করে স্ত্রী ডা: নাজনীন আক্তার জাহানের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে অনুরোধ করেও সম্ভব হয়নি। এসময় ডা: কল্লোল ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, “দেখুন উনি পর্দানশীন ব্যক্তি, বাইরেরর কোন লোকের সাথে কথা বলেন না, তাছাড়া আপনার সাথে কথা বলতে উনি বাধ্যও নন”।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন ডা: এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম পরিবর্তনের অঙ্গীকারকে বলেন, রোগী সম্পর্কে চিকিৎসকের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলবেন না, এটা অন্যায়, সরকারী চাকুরিতে থেকে এভাবে কথা বলতে পারেন না। তাছাড়া কোন চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার দায় তো অন্য চিকিৎসকরা নেবেন না। জেলায় বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা প্রাইভেট কিনিকগুলিতে সন্তান প্রসবকালীন জটিলতায় মা-শিশু মৃত্যুর ঘটনা শুনতে পাই; কিন্তু এসংক্রান্ত কোন অভিযোগ কেউ আমাদের কাছে নিয়ে আসেনি।